শিরোনামঃ

বান্দরবানের

কৃষক আবুল বশরের তৈরি জৈব সার দিয়ে উৎপাদন হচ্ছে বহুমূখি ফসল:খুশি কৃষকেরা

কৌশিক দাশ, বান্দরবান। বান্দরবান সদরের রেইচা এলাকার গোয়ালিয়া খোলা গ্রাম । চারিদিকে সবুজ আর সৌন্দর্যের সমারোহ । শীতকালীন সবজি ভরপূর গ্রামের পর গ্রাম । আর এই সবুজ ফসলকে যিনি প্রাণবন্ত করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন গোয়ালিয়া খোলা গ্রামের কৃষক আবুল বশর।
জেলা সদরের সুয়ালক ,রেইছা বাজার, গোয়ালিয়া খোলা,রোয়াজা পাড়া,ধুঙ্গি পাড়া,রতœপুর,লম্বা ঘোনা ,সাতকমল পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ এখন কৃষি নিভর হয়ে পড়েছে। এখানে প্রতিটি পাড়ায় কম বেশি কৃষকের বসবাস। সম্প্রতি সময়ে এই এলাকার কৃষকেরা বান্দরবান কৃষি অধিদপ্তরে সহযোগিতায় আধুনিক চাষাবাদ সর্ম্পকে নানা প্রকার ধারণা নিয়ে কৃষিজ ফসল উৎপাদন করে যাচ্ছে ।
এই এলাকায় ফসল উৎপাদনের একটি অন্যাতম সহযোগি উপাদন হল জৈব সার। কৃষক আবুল বশরের কাছ থেকে নায্যমুল্যে ক্রয় করে প্রতিটি কৃষক পরিবার এখন স্বাচ্ছন্দে নানা রকম সবজি উৎপাদন করে যাচ্ছে। এই সার ভর্মি কম্পোস্ট যা কেঁচো সার নামে ও পরিচিত।
শীতের একটি সকালে বান্দরবান সদর থেকে মোটর সাইকেল যোগে রওনা হলাম বান্দরবান সদর ইউনিয়নের রেইচা গোয়ালিয়া খোলা এলাকায়। জেলা শহরের কাছে আর সবচেয়ে বেশি সতেজ শাক সবজির উৎপাদন হয় বলে এই গ্রাম এখন সবজির গ্রামে পরিচিত হয়ে উঠছে। যাকে অনেকেই সবজির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মনে করছে। সবুজের সমারহ যেদিকে থাকায় সবুজ ফসলের মাঠ আর মাঠ। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে বিশেষ কিছ আছে কি? মোটর সাইকেল রেখে এক পাঁ দু পাঁ করে হাটা শুরু করলাম কোন কৃষক ভাইয়ের সাথে কথা বলার জন্য, হঠাৎ গ্রাম থেকে হেঁটে আসতে দেখি একজন লোক, তাকে জিঙ্গাস করলাম ভাই কেমন আছেন সেই বলে“ আমি বেশ ভালো আছি” পরক্ষণে জিঙ্গাস করলাম কি করেন? তিনি বলেন আমি একজন কৃষক মাঠে চাষ করি এবং নিজের তৈরি সার দিয়ে ফসল উৎপাদন করি । আমি তৎক্ষণিক উনার দিকে অবাক হয়ে থাকিয়ে থাকি, আমি আর কিছু জিঙ্গাস না করে বললাম আমি কি আপনার তৈরিকৃত সার কেন্দ্রটি দেখতে পারি ? উনি নিমিশে বলে উঠলেন অবশ্যই। তারপর চলে গেলাম শাক সবজির উৎপাদনের মাঠ ও কৃষক আবুল বশরের নিজস্ব উপায়ে তৈরি জৈব সার তৈরির স্থানে।
সেখানে গিয়ে দেখি সুন্দর পরিপাঠি একটি মাটির ঘর। সেখানে তার স্ত্রীসহ ৩ ছেলে সন্তান নিয়ে বসাবাস করে এই আবুল বশর। বাড়ির আঙ্গিনার একপাশে নিম তৈল,জৈব সার,ভর্মি কম্পোস্ট,বালাইনাশক,টাইকো কম্পোস্টসহ নিজের উৎপাদিত বেশ কিছু সারের স্তুপ দেখতে পেলাম। এখানে যে সারটি আমার চোখে তাক লাগালো সেটি ভর্মি কম্পোস্ট । যেমন আমরা বাংলাদেশ চির সবুজের দেশ। আমরা সব সময় সবুজকেই বেশি পছন্দ করি ,যেমন সবুজ দেখতে সুন্দর তেমনি সবুজ সবজি আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
এই আবুল বশর বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বান্দরবানের একটি বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেই ২০১৪ সাল থেকে কৃষি কাজের পাশাপাশি পরিবারের আঙ্গিনায় শুরু করেছে ভর্মি কর্¤েúাস্ট (কেঁচো) সার তৈরি। তিনি জানান, জৈব সার আমাদের মাটি ও ফসলের জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ কারন আমরা যেভাবে কেমিক্যাল ব্যবহার করে মাটির প্রাকৃতিক র্উবরতা কমিয়ে ফেলেছি তাতে করে মাটির জন্য প্রাকৃতিক জৈব সার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি এই ভর্মি (কেঁচো)সার আবার মাটির সাথে ব্যবহার করতে পারি তাহলে আশা করি মাটি তার উর্বরতা ফিরে পাবে।
কথা প্রসঙ্গে এই সার নিয়ে আলাপ হয় একই গ্রামের কৃষক নুর মোহাম্মদ। তিনি জানান এই জৈব সার খুবই ভাল একটি সার । এই কেঁেচা সার এমন একটি সার যেটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে বহুগুণ। আগে আমাদের মত কৃষকদের বাজার থেকে চড়াদামে সার ক্রয় করতে হতো যার ফলে ফসল উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত খরচ হতো , এখন আবুল বশরের তৈরি সার দিয়ে আমাদের গ্রামের সবাই চাষাবাদ করছি, এতে করে আমাদের নিজের খরচ অনেকটা কমেছে উৎপাদন ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
কৃষক আবুল বশর জানিয়েছেন ,কেঁচো সার তৈরি করে ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে জানুয়ারির এই পযন্ত প্রায় ৪৫ হাজার টাকার কেঁচো সার বিক্রয় করেছেন তিনি। প্রতিবছর তার নিজের চাষের কাজে ব্যবহার করে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি বাজারে বিক্রয় করে। বর্তমানে তিনি ৪শতক জমিতে নিজের তৈরি সার দিয়ে শীম,লাউ,বেগুণ,ক্যাপসিকাম,মরিচ,কুমড়া,স্বস্কোস,শসা,ইত্যাদি উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন। আবুল বশরের দেখাদেখি এখন রেইছাসহ বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকার অনেক কৃষক লাভের মূখ দেখেছেন। কেঁচো সার ব্যবহার করে ফলিয়েছেন বিষমুক্ত সবজি। আবুল বশর জানান, আমি ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সার তৈরি করে নিজের চাষাবাদ পরিচালনা করি। গোবর,তরকারি অবশিষ্ট অংশ,চালের গুড়–,ঘাস,সুটকির গুরু,গরুর রক্ত,মাছ ধোয়া পানি,ব্যবহারিত চাপাতা দিয়েই এই ভর্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার তৈরি করা হয়। এ সারের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারনে আমরা বিষমুক্ত বিভিন্ন শাক সবজি উৎপাদন করতে পারছি। গোয়ালিয়া খোলার চাষিদের বেশ কয়েকটি সমবায় সমিতি এখন চাষীদের জৈব সার পদ্ধতিতে চাষ করতে উৎসাহিত করছে। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা ও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কৃষক বশর জানান, সরকার কর্তৃক আমাকে সার তৈরির রেজিষ্ট্রশন সুবিধা ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হলে আমি আমার নিজের তৈরি এই সার বান্দরবানের চাহিদা মেটানো পারবে আর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করতে পারবো।
ভর্মি কম্পোস্ট সার তৈরির প্রশিক্ষণ সর্র্ম্পকে জানতে চাইলে সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো:ওমর ফারুক বলেন, আমরা কেঁেচা কম্পোস্ট তৈরি জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। গোয়ালিয়া খোলার আবুল বশর সফলতার মূখ দেখছে। আবুল বশরের দেখাদেখি এখন অনেক কৃষিক রাসায়নিক সার ত্যাগ করে কেচোঁ সারের দিকে অগ্রসারিত হচ্ছে। অনেক কৃষক কেঁেচা সার তৈরিতে ইতোমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করছে ।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো:আলতাফ হোসেন বলেন, কেঁেচাতে জিবরাইলিক অ্যাসিড নামের এক ধরণের পদার্থ নিঃসরণ করে। গোবর ও পচনশীল উপাদানের সঙ্গে ওই অ্যাসিড মিশে গেলে ইউরিয়া,পটাশসহ বিভিন্ন রাসায়নিক সারের গুণাগুণ এক সঙ্গে পাওয়া যায়। এজন্য এই জৈব সার ব্যবহার করলে আর অন্য কোন সার ব্যবহার করা প্রয়োজন হয় না। তিনি আরো বলেন,বান্দরবানে অনেক কৃষক এখন রাসায়নিক সার ত্যাগ করে জৈব প্রযুক্তির কেঁেচা সার ব্যবহার করা শুরু করেছে। এরই মধ্যে সুয়ালক,গোলিয়াখোলা,ডলুপাড়া ও ক্যামলংয়ের চাষিদের মধ্যে এটি জনপ্রিয় সারে পরিণত হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 316 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen