শিরোনামঃ

কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা, শেষ ভরসা রাষ্ট্রপতি

সিএইচটি টুডে ডট কম ডেস্ক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এরই মধ্যে পরোয়ানাটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে জেল কোড অনুযায়ী শেষ ভরসা হচ্ছে রাষ্ট্রপ্রতি, তিনি প্রান ভিক্ষা দিলেই কেবল ফাসির কাঠগড়া থেকে বাচতে পারেন কাদের  মোল্লা।kader molla

কাদের মোল্লাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় ৫ ডিসেম্বর প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। এ রায় ৭৯০ পৃষ্ঠার। রায় প্রকাশিত হওয়ার আগে এতে সই করেন বিচারপতিরা।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ওই রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার দুই মাস ১৮ দিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে সুপ্রিম কোর্টের সাদা রঙ্গের একটি গাড়িতে করে (ঢাকা মেট্রো-চ ৫৩-৭৪৮১) রায়ের অনুলিপি পাঠান।
আজ দুপুর ১২টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে রায়ের অনুলিপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়।
রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) করার সুযোগ আছে কি না, এ নিয়ে সরকার ও আসামিপক্ষ দুই ধরনের মত দিয়েছে। সরকারপক্ষ বলছে, আইনে পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। দণ্ড কার্যকর সরকারের ওপর নির্ভর করছে। আর আসামিপক্ষ বলছে, রায় পুনর্বিবেচনা আসামির সাংবিধানিক অধিকার।
কাদের মোল্লাকে গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার (পার্ট-২) থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী  সেদিন বলেছিলেন, রায়ের অনুলিপি হাতে পেলে কাদের মোল্লাকে কনডেম সেলে (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ) রাখা হবে।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই অন্য একটি মামলায় কাদের মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়।  ওই বছরের ১৪ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তদন্ত শুরু হয় ২১ জুলাই। গত বছরের ২৮ মে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ৩ জুলাই থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ৫ ফেব্রয়ারি তাঁকে যাবজ্জীবন সাজার রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
আসামির রিভিউর জন্য অপেক্ষা করবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে রেজিস্ট্রার বলেন, এটা আমাদের কাজ নয়। রিভিউ দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমাদের কাজ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর জেল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া।

অন্যদিকে আবদুল কাদের মোল্লার আইনজীবী তাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যেদিন সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়েছে, সেদিনেই পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফাইড কপি চেয়ে আপিল বিভাগে একটি আবেদন করা হয়েছে। আমরা সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার পর রিভিউ পিটিশন দায়ের করব। এক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী ৩০ দিন সময় দেয়া থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত সময় লাগবে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সময় নেব। ৩০ দিনের আগে সাজা কার্যকর করার কোনো অধিকার কারা কর্তৃপক্ষের নেই বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, জেল কোড অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করারও সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া জেল কোড অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার পর সাজা কার্যকরের ক্ষেত্রে ২১ দিনের আগে নয়, আবার ২৮ দিনের পরে নয় সংক্রান্ত যে বিধান রয়েছে তা কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা কার্যকর করবে সরকার। তাই এক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

 কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে  :


প্রথম অভিযোগ (পল্লব হত্যা): কাদের
 মোল্লার নির্দেশে আকতার গুন্ডা একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা করেন। রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পাওয়া গেছে, একাত্তরে নবাবপুর থেকে পল্লবকে ধরে আনার মতো দুষ্কর্মে আসামির ‘সহযোগিতা’ ছিল। পল্লব মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, এ জন্য তিনি আসামির শিকারে পরিণত হন। এ হত্যাকাণ্ড ছিল দেশের বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ।


দ্বিতীয় অভিযোগ (কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা): এ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৭ মার্চ কাদের মোল্লা তাঁর সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তাঁর মা এবং দুই ভাইকে মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন। রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়, সহযোগীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে কাদের মোল্লা এ হত্যাকাণ্ডে ‘নৈতিক সমর্থন’ ও ‘উত্সাহ’ জুগিয়েছেন, যা দুষ্কর্মে ‘সহযোগিতার’ মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।


তৃতীয় অভিযোগ (সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা): একাত্তরের ২৯ মার্চ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুরের জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা জবাই করে হত্যা করেন। প্রাপ্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, খন্দকার আবু তালেব হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লা মূল অপরাধীদের নৈতিক সমর্থন ও উত্সাহ জুগিয়েছেন, যা মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতার মধ্যে পড়ে।


চতুর্থ অভিযোগ (ঘাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড): একাত্তরের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ১১টা পর্যন্ত কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটার চর (শহীদনগর) এলাকায় শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও দুজন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন। এ বিষয়ে রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী আবদুল মজিদ পালোয়ান ও অষ্টম সাক্ষী নূরজাহান বেগম যে আসামিকে চিনতেন, তা প্রাপ্ত সাক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল বিশ্বাস করতে পারেননি। ফলে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় না যে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাকিস্তানি সহযোগীদের সঙ্গে রাইফেল হাতে কাদের মোল্লা নিজে উপস্থিত ছিলেন। হত্যাকাণ্ড যে ঘটেছিল, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে।


পঞ্চম অভিযোগ (আলুব্দীতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ): একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি হেলিকপ্টার মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামের পশ্চিম দিকে নামে। কাদের মোল্লা অর্ধশত অবাঙালি, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিয়ে গ্রামের পূর্ব দিক থেকে ঢোকেন এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। ওই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মারা যান। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে, হত্যাকাণ্ডের সময় কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে সশরীরে উপস্থিত দেখা গেছে। কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ যখন অনেক ব্যক্তি ঘটায়, তখন ওই ব্যক্তিদের প্রত্যেকে ওই অপরাধ এককভাবে সংঘটনের জন্য সমানভাবে দায়ী।


ষষ্ঠ অভিযোগ (হযরত আলী, তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণ): একাত্তরের ২৬ মার্চ মিরপুরের ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর কালাপানি লেনের হযরত আলী, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই বছরের ছেলেকে হত্যা এবং তাঁর ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের সঙ্গে কাদের মোল্লা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হযরতের আরেক মেয়ে ওই ঘটনা লুকিয়ে থেকে দেখেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন হযরতের পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য লুকিয়ে থাকা ওই মেয়ে। রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধের ঘটনাস্থলে কাদের মোল্লার উপস্থিতি অপরাধের সঙ্গে তাঁর সংযুক্ততা প্রমাণ করে। আইনগতভাবে ধরে নেওয়া যায়, অপরাধ সংঘটনে আসামি নৈতিক সমর্থন ও সাহায্য করেছেন।
সংক্ষিপ্ত রায় অনুসারে, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগ ছাড়া বাকি পাঁচটি অভিযোগে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা বা সহযোগিতার জন্য, পঞ্চম অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে হত্যা ও ধর্ষণের অপরাধে কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
শাস্তির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বলা হয়, হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ মানবতাবোধের জন্য এক প্রচণ্ড আঘাত, ট্রাইব্যুনাল তা বিবেচনায় নিয়েছেন। অপরাধে আসামির সম্পৃক্ততার ধরন ও অপরাধের গভীরতা ট্রাইব্যুনাল সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। শাস্তি এমন হতে হবে যেন অপরাধের গভীরতার সঙ্গে অপরাধীর দায়ের মাত্রা সম্পর্কযুক্ত হয়। ট্রাইব্যুনাল একমত যে, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগের জন্য কাদের মোল্লা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগের জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।
চূড়ান্ত আদেশে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ২০(২) ধারা অনুসারে কাদের মোল্লাকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

এ রায়ের পর তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ সমাজের ডাকে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। পরে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সমান সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আগে আইনে সরকারের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ ছিল না। গত ৩ মার্চ সর্বোচ্চ শাস্তি  চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরদিন আপিল করেন কাদের মোল্লা। গত ১ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু হয়।

আসামি ও সরকার—উভয় পক্ষের দুটি আপিলের ওপর ৩৯ কার্যদিবস শুনানি শেষে গত ২৩ জুন আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। শুনানি শেষ হওয়ার ৫৫ দিনের মাথায় ১৭ সেপ্টেম্বর রায় দেওয়া হয়।

আপিল বিভাগের রায়ে কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যাপারে পাঁচ বিচারপতি একমত হলেও মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহ্াব মিঞা ভিন্নমত দেন।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 224 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen