সিএইচটি টুডে ডট কম ডেস্ক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ।
বুধবার রায়টি প্রকাশের জন্য সুপ্রিম কোর্টের সেকশনে পাঠানো হয়।এর আগে রায়ে পাঁচ বিচারপতি স্বাক্ষর করেন। বুধবারই এই রায় প্রকাশের কথা ছিল।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সাজা বাতিল করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ রায় দেন।
প্রধান বিচারপতি ছাড়াও আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।গত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
আসামি ও সরকার—উভয় পক্ষের দুটি আপিলের ওপর ৩৯ কার্যদিবস শুনানি শেষে গত ২৩ জুলাই আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন।
রায়ে আদালত বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারের করা আপিল গ্রহণযোগ্য। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সরকারের আপিল মঞ্জুর করা হলো। চতুর্থ অভিযোগ (ঘাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড) থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আসামিকে খালাস দিয়েছেন, রায়ের এ অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে বাতিল করা হলো। এ অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
ষষ্ঠ অভিযোগে (সপরিবারে হযরত আলী লস্কর হত্যা ও ধর্ষণ) সংখ্যাগরিষ্ঠ (৪: ১) মতামতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ঝোলানো হবে। সর্বসম্মতিক্রমে কাদের মোল্লার করা আপিল খারিজ করা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে আনা ষষ্ঠ অভিযোগ সর্বসম্মতিতে গ্রহণযোগ্য।
আর প্রথম (পল্লব হত্যাকাণ্ড), দ্বিতীয় (সপরিবারে কবি মেহেরুননিসা হত্যা), তৃতীয় (সাংবাদিক আবু তালেব হত্যাকাণ্ড) ও পঞ্চম অভিযোগে (আলুব্দী হত্যাযজ্ঞ) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ (৪:১) মতামতে বহাল রাখা হলো।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
পঞ্চম অভিযোগ হলো: মিরপুরের আলুব্দী গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং ষষ্ঠ অভিযোগ হলো হযরত আলী, তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণ। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে তাঁকে ১৫ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এসব অভিযোগ হলো: পল্লব হত্যা, কবি মেহেরুননেসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা। চতুর্থ অভিযোগ (কেরানীগঞ্জের ঘাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড) থেকে তিনি খালাস পান।
ঘটনা প্রবাহ: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ রায়ের পর তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ সমাজের ডাকে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। পরে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সমান সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আগে আইনে সরকারের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ ছিল না। গত ৩ মার্চ সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরদিন আপিল করেন কাদের মোল্লা। গত ১ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান শুনানিতে অংশ নেন। আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাদের সহায়তা করেন আইনজীবী শিশির মুনির।
আপিল শুনানিকালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন ওঠায় ২০ জুন আপিল বিভাগ অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে জ্যেষ্ঠ সাত আইনজীবীর নাম ঘোষণা করা হয়। তাঁরা হলেন: টি এইচ খান, রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কিউসি এবং এ এফ হাসান আরিফ।
প্রশ্ন দুটি হলো—দণ্ড ঘোষণার পর আইনে আনা সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে কি না? অ্যামিকাস কিউরিরা ৮ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত মতামত দেন।
জানা গেছে, আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করবে আসামিপক্ষ।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ অভিযোগ গঠন করে। এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন।