শিরোনামঃ

মিডিয়া ভাবনা

মফস্বল সাংবাদিকতা নিয়ে ভাবতে হবে : এস বাসু দাশ

খুব কষ্ট হয়, যখন দেখি মফস্বলের কোন কোন সাংবাদিক সহকর্মী মাসের পর মাস সন্মানি/বেতন পায় না। পরিবার নিয়ে চলতে বেকায়দায় পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। কেউ কিছু পায়, তবে যা পায় তা একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতনের bashu-চেয়ে অনেক কম। আর্থিক টানাপোড়নে দিনের পর দিন চলে যায়, যায় রাতের পর রাত। তবুও ভাগ্য সহায় হয় না, কোন পরিবর্তন হয় না তাঁদের। এই অবস্থার জন্য কে দায়ী, যাঁরা এই পেশায় আসে তাঁরা? দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র? নাকি সাংবাদিক নেতারা?
ঢাকায় কোন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হলে মফস্বলের সংবাদকর্মীরা কেন্দ্রিয় কর্মসূচী হিসাবে
সারাদেশে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেন। নি:সন্দেহে এটা ভালো দিক কিন্তু মফস্বলের কোন সংবাদকর্মী নির্যাতনের শিকার হলে ঢাকার সাংবাদিক নেতাদের আন্দোলন দূরে থাক, একটি বিবৃতি দিতেও দেখা যায় না। তাঁরা কেন এমনটি করেন?
ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ওয়েজ বোর্ড এর দাবীতে সাংবাদিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করে আসছে। সে আন্দোলনে মফস্বলের সংবাদকর্মীদের ওয়েজ বোর্ডের আওতায় আনার দাবী কখনো কোন সাংবাদিক নেতা করেছেন কিনা আমার জানা নেই। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালের রাজবাড়ী জেলা জাসদের সভাপতি আহমদ নিজাম মন্টুর বাসায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, মফস্বল সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিন্তু আসলে কি নেওয়া হয়েছে কোন পদক্ষেপ?
টক শোতে আমাদের অনেক শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নেতাকে বলতে দেখি শ্রমিকদের বেতন বৈষম্যের কথা, শ্রমিকদের অশ্রুসজল কান্নার কথা কিন্তু নিজ প্রতিষ্ঠানের কথা তারা কি কখনও বলেন? বেতন না দিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর মফস্বলের সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে কাজ আদায় করার কথা। ৭ম এরপর ৮ম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, ৮ম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করার কথা বলে দেশের অনেক পত্রিকা তাদের বিজ্ঞাপন দর দ্বিগুণ করেছে কিন্তু মফস্বলে এই ওয়েজ বোর্ডের ন্যুনতম সুবিধা পান কতজন সংবাদকর্মী।
ঢাকায় বিভিন্ন বিট কাভার করার জন্য রয়েছেন আলাদা আলাদা প্রতিবেদক। জেলায় যারা কাজ করেন তাদের সব বিষয়ে ৩৬৫দিনেই কাজ করার পারদর্শী হতে হয়, সেই সাথে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ানোর কাজ। প্রতিযোগীতা মূলক সাংবাদিকতার এই যুগে এই পেশায় থেকে অন্যকিছু করে খাওয়ার দিন কি সত্যি আছে এখন। অনেক পরিশ্রমী না হলে এ পেশায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়। নানা বাধা অতিক্রম করেই দেশের আনাচে-কানাচের সংবাদ মফস্বল সাংবাদিকরাই তুলে আনেন কিন্তু তারা তারপরও অফিসগুলোতে সঠিক মর্যাদা পায় না, হয় অবহেলার পাত্র। দেশে এমনও প্রতিষ্ঠিত ইলেকক্ট্রনিক মিডিয়ার অন্দরমহলের সংবাদ পায় যারা প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা ১২ বছর তাদের প্রতিনিধিদের এক টাকা সন্মানি প্রদান না করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
উপজেলার সংবাদকর্মীদের কথা নাই বা বললাম, কেবল জেলা প্রতিনিধিদের গুটি কয়েক দৈনিক ও টিভি চ্যানেল মাসিক সম্মানী ভাতা দিয়ে থাকেন। মফস্বলে অনেক সংবাদকর্মী সন্মানের সাথে টিকে থাকতে একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কিন্তু একটি জেলায় এই ধরণের কতজন পাওয়া যাবে। আবার এমনও প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ২ হাজার সন্মানি দিয়ে অন্যপ্রতিষ্ঠান তথা অন্যকোন কাজ করা যাবে না, কতটা টাউট হলে একথা বলেন। মফস্বলের সংবাদকর্মীরা খালি পেটে কাজ করবেন তারা এমনও আশা করেন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান!।
বছরের অসহায়ত্বের দিনগুলো পাড়ি দিয়ে কোন উৎসবের দিন আসলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সন্মানী পায় না। আর যারা দেয় তাঁরা আবার মফস্বলের কর্মীদের বোনাস দিতেই ভুলে যান। অনেকেই মনে করেন, মফস্বলের এসব সংবাদ শ্রমিকদের আবার কিসের উৎসব, তা না হলে কেনই বা এমন ঘটে মফস্বলের বেলায়। উৎসব আসলেই মফস্বলের অনেক সংবাদকর্মী রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে উৎসব পালন করার জন্য সহযোগীতার আশায় বসে থাকেন এমন অসহায়ত্বের কথাও শুনি। কিন্তু এসব সংবাদকর্মীদের কেন নেতাদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হবে। কেন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে চলে যাবে মফস্বলের সাংবাদিকতা, এর জন্য কারা দায়ী?
১৯৯৬ সালের পর প্রথম বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল শুরু হওয়ার পর দেশে বর্তমানে অনুমোদন পাওয়া ৪৪টি টিভি চ্যানেল রয়েছে, যার মধ্যে চালু রয়েছে ২৬টি। বেসরকারী টিভি চ্যানেলের মধ্যে সিংগভাগই অনুমতি পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বর্তমানে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ১ হাজার ২৪৪টি, যার মধ্যে সরকারের বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্ত ৪৭৭টি। অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারী এফএম বেতার ২৮টি ও কমিউনিটি রেডিও ৩৪টি। দেশে একের পর প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেক্টনিক্স মিডিয়া আসছে। কেন আসছে, কারা আনছে, কি জন্য আনছে। দেশের জন্য? দশের জন্য? সমাজকে কিছু দেবার জন্য?
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে অনেক বিত্তশালী, কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ী এখন পত্রিকা বের করছে। পত্রিকার সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মফস্বল সাংবাদিকের সংখ্যাও কিন্তু কতটা বাড়ছে মফস্বল সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের মান।
একসময় মিডিয়া কম ছিলো কিন্তু মফস্বলে প্রতিযোগীতা ছিলো বেশি। একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে কত কাটখড় পুড়াতে হয়েছে প্রবীণ সংবাদকর্মীরাই কেবল জানেন। এখন মিডিয়া বেশি মফস্বল সংবাদদাতার সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু বাড়েনি মফস্বল সংবাদদাতাদের সুযোগ-সুবিধা ও মান। কোনদিন পত্রিকায় দুইলাইন লিখেনি তিনিও এখন মফস্বল সাংবাদিক,বাড়ছে কাট আর পেষ্টের সাংবাদিকতা। অভিজ্ঞতা-যোগ্যতার প্রয়োজন নেই, সন্মানি দেওয়ার দরকার নেই “ধান্ধাবাজি করে খা” এই মনোভব নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো উঠতি বয়সের বেকার যুবকদের শুধু ’পরিচয় পত্র’ দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার কারনে মফস্বল থেকে সৎ ও নির্ভীকতার সাংবাদিকতা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের সংবাদকর্মীদের বেতন নয়, সম্মানীর নামেও কিছু দেয়না, তারা কি করে দেশ ও দেশের মানুষকে ভাল কিছু দিবে। মফস্বলে সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকতা বুকে ধারণ করে এখনও যারা পথ চলছে তারা কতটুকু ভালো আছে? নবীনদের অধিকাংশই পথচলার শুরুতেই বিপথে চলতে শুরু করেছে, যদিও এর সংখ্যা এখনো অতি নগণ্য।
এই অবস্থার উন্নতি না হলে মফস্বলে মেধাবী, সৎ, যোগ্য ছেলে-মেয়েরা আসবে এই মহান পেশায়? কে জেনে শুনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াবে। এখনও সময় আছে, একবার ভাবুন মফস্বল সাংবাদিক আর সাংবাদিকতা নিয়ে।

 

লেখক- এস বাসু দাশ
পাহাড়ের সংবাদকর্মী।
sbashu@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 663 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen