আরিফুল হক মাহবুব, কাউখালী (রাঙামাটি)। চেক জালিয়াতি, ভূয়া ঋণ উত্তোলন, সঞ্চয় ও ডিপিএস জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রামীন ব্যাংক কাউখালী শাখা হতে গ্রাহকের ১ কোটি ২৩ লাখ আত্মসাৎ করেছেন এক কর্মকর্তা ও তিন মাঠ কর্মী। ব্যাংকের ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের অডিট চলাকালীন চাঞ্চল্যকর এ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ে। প্রাথমিক ভাবে এক কর্মকর্তা ও তিন মাঠকর্মীসহ চারজন জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাদেরকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এক কোটি তেইশ লাখ আত্মসাতের দায়ে যাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন এরিয়া ম্যানেজার মোঃ ইমরান হোসেন (৪৯১৬২), মাঠ কর্মী মোঃ সারওয়ার হোসেন (৩১৫৩৪), মাঠ কর্মী মঞ্জুর চাকমা (৩৪২৭৯), মাঠ কর্মী মমতাজ বেগম (২৯৭৪১)।
সরজমিন ঘুরে গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ২০০৫ সালে রাঙামাটির কাউখালীতে শাখা গড়ে তোলে গ্রামীন ব্যাংক। উপজেলার প্রতিটি পাড়ার কেন্দ্র গঠন করে গ্রুপ তৈরীর মাধ্যমে গ্রাহক সৃষ্টি করা হয়। প্রথম দিকে গ্রাহকরা তেমন আগ্রহ না দেখালেও সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের মাত্রা অতিরিক্ত হয়রানী, উপজেলায় বেসরকারী ব্যাংকের কোন শাখা না থাকা এবং রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকের তুলনায় লভ্যাংশ বেশী হওয়ায় গ্রামীন ব্যাংকের দিকে ছুটতে থাকে গ্রাহকরা। ফলে নয় বছরে তারা পনেরশ’র অধিক গ্রাহক তৈরী করতে সক্ষম হয়।
এ ব্যাংকের দায়িত্ব থাকা স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ছোটখাট অভিযোগ থাকলেও ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ধরা পড়ে এক কোটি তেইশ লাখ টাকার চাঞ্চল্যকর আত্মসাতের ঘটনা। ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী এক বছরেরও কম সময়ে এত বড় অংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় খোদ ব্যাংকের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ হতভম্ব হয়ে যান। তবে কোন কোন খাত থেকে তারা টাকা আত্মসাত করেছেন তা বের করতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে জানিয়েছেন ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হিসাবে সদস্য দয়িত্ব প্রাপ্ত খালেদ মোহাম্মদ আলী বাবু।
সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গ্রাহকরা এ ব্যাংকে সদস্য হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকেন। ঋণ গ্রহণের পর পাশ বই গ্রহকদের ফেরৎ না দিয়ে মাঠ কর্মীরা নিজের নিয়ন্ত্রনে রেখে দেন। এছাড়াও মেয়াদী ডিপিএস ও সঞ্চয়ের টাকা গ্রাহকরা জমা দেন পাশ বই ছাড়াই। জমাকৃত টাকার বিরপরীতে গ্রাহকদের দেয়া হয়না কোন রশিদ। ফলে এসব বেশীর ভাগই আত্মসাৎ করার সুযোগ পেয়েছেন অভিযুক্তরা। অনেক গ্রাহক সরল মনে কোন ডকুমেন্ট ছাড়াই মাসে টাকা জমা দিতেন। গ্রাহকরা জমাকৃত এসব টাকার কোন প্রমাণপত্র বা পাশবই চাইলে অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার কথা বলা হতো।
চেক জালিয়াতির মাধ্যমে উপজেলা সদরের মুদি দোকানি সুজন কান্তি দে’র একাউন্ট থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এক লক্ষ টাকা। সুজন জানান, এরিয়া ম্যানেজার ইমার হোসেন জরুরী খবর দিয়ে আমাকে গ্রামীন ব্যাংক অফিসে ডেকে পাঠান। তখন আমাকে বলা হয় আমার হিসাব নম্বরে ভূলবশত অন্য গ্রাহকের এক লক্ষ টাকা জমা হয়েছে। এ টাকা সমন্বয় করার জন্য আপনাকে একটা চেক দিতে হবে। এই বলে সহজ সরল সুজনের কাছ থেকে ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর নিয়ে এক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। পরে সুজন তার হিসেব নম্বর থেকে টাকা উত্তোলন করতে গেলে তার একাউন্টে কোন টাকা নেই বলে জানানো হয়।
এছাড়াও লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে মেয়াদী বীমাকারীদের কাছ থেকে। রাঙ্গুনীয়ার ইসলামপুর ১নং ওয়ার্ডের দিনমুজুর নুরুল ইসলাম ও স্ত্রী মিনু আক্তার দুই মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তা করে ১০০ ও ৫০ টাকার বীমা করেছিলেন। বীমা দুটি যথাক্রমে ৯ বছর ২ মাস ও ৮ বছর চার মাস চালিয়েছেন। গত এক বছর ধরে বীমার টাকা জমা দিয়েছেন কোন রশিদ ও পাশ বই ছাড়াই। একদিন খোজ নিয়ে দেখেন তার একটি বীমায় ২৪শ টাকা ও অন্যটিতে মাত্র ৪হাজার টাকার মত রয়েছে। অবশিষ্ট টাকার কোন হদিস নেই।
সবচেয়ে বেশী জালিয়াতি হয়েছে গ্রাহকের নামে ভূয়া ঋণ উত্তোলনের মাধ্যমে। উপজেলা তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ সেলিম (৫০) কোন ঝক্কি ঝামেলা পছন্দ করেন না। গ্রামীন ব্যাংকে দশ বছর মেয়াদী বীমা করেছেন। মাসে মাসে ধার্যকৃত টাকা জমা দিয়ে আসেন ব্যাংকে। ব্যাংকের কোন কর্মকার্তা কর্মচারীর সাথেও তেমন পরিচয় নেই। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলেন তার নামে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা ঋণ আছে গ্রামীন ব্যাংকে। যার কিস্তি ঠিকমত পরিশোধ করা হচ্ছে না। এখবর শুনে তুলা কর্মকর্তা মূর্চা যাওয়া অবস্থা। কাউখালী বিদ্যুৎ অফিসের কর্মচারী মোঃ মামুন (২৫), তার নামে ভূয়া ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে দুই লক্ষ টাকা। উপজেলা সদরের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ভগ্নিপতির নামে উত্তোলন করা হয়েছে দুই লক্ষ টাকার ভূয়া ঋণ।
এভাবে গ্রামীন ব্যাংক কাউখালী শাখার ৩০ টি কেন্দ্র থেকে এক কোটি ২৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অভিযুক্ত চার ব্যাক্তি। ২০১৩-১৪ বছরের অডিট চলাকালীন এ জালিয়াতি ধরা পড়ার পর তাৎক্ষনাৎ এ্যারিয়া ম্যানেজার ও তিন মাঠ কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তারা রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই মূহুর্তে টাকা আত্বসাতকারী সবার সম্পদের হিসাব পাওয়া না গেলেও মাঠ কর্মী মোঃ সারওয়ার হোসেন, পরিচিতি নং- ৩১৫৩৪, গ্রামের বাড়ী চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলায়। ২০০৫ সালে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে বরখাস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত চাকুরী করেছেন কাউখালী শাখায়। গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে তিনি অর্ধ কোটি টাকার মালিক বনেছেন। তার গ্রামের ফটিকছড়িতে ৫টি সিএনজিসহ তার নামে স্থায়ী সম্পদ রয়েছে বলেও জানাগেছে।
এসব জালিয়াতির খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামীন ব্যাংক কাউখালী শাখার গ্রাহকদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি কেন্দ্র হতে গ্রাহকরা প্রতিদিন তাদের জমাকৃত সঞ্চয়ের টাকা উত্তোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে ধ্বস নামে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম। গ্রাহক শূণ্য হয়ে পড়েছে শাখাটি।
এব্যাপারে কথা হয় গ্রামীন ব্যাংকের ডিজিএম আব্দুস সালামের সাথে। তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এক কোটি ২৩ লাখ টাকার মত আত্বসাতের প্রমাণ মিলেছে। ফাইনাল অডিট রিপোর্ট আসার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্রাহকদের টাকা কে ফেরৎ দিবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আতংকিত হওয়ার কোন কারণ নেই। গ্রামীন ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যায়নি। তিনি জানান, গ্রাহকদের টাকা এক মাসের মধ্যেই ফেরত দেয়া হবে।