১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক-বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসর্ম্পন করলেও আমরা জানতে পারিনি। জানবোই বা কিভাবে? ১৬ ডিসেম্বর তারিখেও আমরা সারাদিন পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মত্ত।একটু ব্যাখ্যা দিয়েই বলি।
ডিসেম্বরের ১২ তারিখ আমি হরিনার যুদ্ধক্ষেত্রে। আমাকে বিশেষ বার্তায় দেমাগিরি সদর দপ্তরে যাওয়ার আদেশ এলো। আমি ১৩ তারিখ প্রত্যাবর্তন করলাম। জেনারেল সুজান সিং উবান আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠান। সেখানে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি ও শেখ সেলিম উপস্থিত ছিলেন। আমি শেখ ফজলুল হক মনির অতি প্রিয়ভাজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। তিনি ও জেনারেল উবান বললেন ১৫ই ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি শহর দখল করার বিশেষ এক দলের সাথে আমাকে যেতে হবে। আমার সাথে সহযোদ্ধা থাকবেন শামসুদ্দিন যিনি ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হবেন মেজর সুরী। ১৭০ জন সৈন্য বিশিষ্ট স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটা কোম্পানি এবং আমরা দুই মুক্তিযোদ্ধা থাকবো এই বিশেষ দলে। ১৪ ডিসেম্বর মেজর সুরী আমাদের ও অন্য সৈনিকদের ব্রিফিং করলেন। জানালেন আমরা ১৫ ডিসেম্বর ভোর সকাল রাঙামাটির অদুরে কুতুকছড়ি নামক এক জায়গায় অবতরণ করবো। সেখান থেকে আমাদের মিশন হবে রাঙামাটি দখল। ১৫ ডিসেম্বর ভোর সকালে আমাদের হাতিয়ার আর সবুজ ইউনির্ফম সজ্জিত দুই সহযোদ্ধা বন্ধু হেলিপ্যাডে উপস্থিত হলাম। ৩টি হেলিকপ্টার প্রস্তুত। ভারতীয় সৈনিকদের সাথে আমরা দুজন হেলিকপ্টারে সওয়ার সাথে আছেন কোম্পানি অধিনায়ক মেজর সুরী। আসন গ্রহণ করলাম। ৩০/৩৫ মিনিট উড়ে আমাদের কুতুকছড়ি গ্রামে ফুরোমোনের কোল ঘেষা এক ধানক্ষেতে নামিয়ে দিয়ে হেলিকপ্টারগুলো চলে গেলো অবশিষ্ট সৈনিকদের আনতে। আমাদের নামিয়ে দেয়ার ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যে পাকবাহিনীর গাড়ীর বহর মানিকছড়ি-মহালছড়ির রাস্তায় এসে অবস্থান নিলো। মেজর সুরীর নেতৃত্বে একটা ফাইটিং পেট্রোল পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে গেলাম। মুহুর্তের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হলো। হেভী মেশিন গানের ফায়ারের সাথে সকলের সাথে থাকা অটোমেটিক ক্ষুদ্রাস্ত্রের গোলাগুলিতে সকাল ১০টার মধ্যে রনাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠল। সেই সাথে চললো দুইপক্ষ থেকেই ৩ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার ….ড্রিম….ড্রিম….ড্রিম। রনাঙ্গনের তীব্রতা বাড়তে থাকলো। চারিপাশে বারুদের গন্ধে থাকা দায়। সম্মুখ যুদ্ধ থেমে থেমে চললো সন্ধ্যা অবধি। কোথায় খাওয়া, কোথায় দাওয়া। বুড়–ক্ষ দুই বন্ধু শক্রু মোকাবিলায় ব্যস্ত। সন্ধ্যায় পাকিস্তানিদের পক্ষে গোলাগুলি সীমিত হয়ে এলো। এ ছাড়াও রাতের অন্ধকারে আর শীতের কুয়াশায় দৃশ্যমান কিছু ছিলনা। রাতে আমরা আমাদের অবস্থান দৃঢ় করে নিলাম। কৌশলগত দিক চিন্তা করে আমাদের মাটি খুড়তে করতে বলা হলো। মাটি যে এতো শক্ত হতে পারে কল্পনাই করতে পারিনি। ভোতা শাবল, বেলচা দিয়ে মাটি খুড়তে গিয়ে গলদঘর্ম হলাম দুজনেই। গভীর রাত অবধি পাকবাহিনীর গাড়ি চলাচলের শব্দ গুনলাম, হেড লাইটের আলোও দেখা গেল। ভয়ও পেলাম – কাল যে কি হবে?
পরদিন ১৬ ডিসেম্বর। সকাল বেলা পাক বাহিনী আমাদের অবস্থানে আক্রমণ করে বসলো। ট্রেঞ্চের ভিতর দাঁড়িয়ে আমরা সাবলীলভাবে পাক আক্রমণ প্রতিহত করলাম। এখন দুই বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি এবং মাঝখানে দুরত্ব ৪০০/৫০০ গজ। থেমে থেমে চলছে বিক্ষপ্ত গোলাগুলি আর মর্টার এর গোলা বর্ষণ। খারাপ নয়, বেশ ভালোই লাগছে। ডিসেম্বর মাসে রৌদ্র¯œাত দিন, মেঘমুক্ত আকাশ, শক্রু মুখোমুখি আমরা দু’বন্ধু। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। লক্ষ্য করলাম বিকেল থেকে পাকিন্তানিদের পক্ষে গোলাগুলির মাত্রা এবং তীব্রতা কমেছে। আমরা কিছুই বুঝলাম না। বেলা বিকেল, সময় ৪টা। মেজর সুরী আমাকে আর শামসুদ্দীনকে ডাকলেন। ঢাকার সামগ্রিক যুদ্ধে অবস্থা সম্পর্কে কিছুই বললেন না। আজ আমার জানতে ইচ্ছে করে উনি কি ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর জানতেন যে ঢাকার ঠিক ঐ সময় জেনারেল এ.এ.কে নিয়োজিত মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসর্ম্পন করতে যাচ্ছে। হয়তো জানতেন, কিন্তু আমাদের বলেন নি। এও হতে পারে তিনি নিজেও জানতেন যে ঢাকার পতন শুরু হয়েছে। তিনি আমাদের স¯েœহে ডাকলেন। বাহ্ বা দিলেন। বললেন ভালোই তো যুদ্ধ করেছো। তিনি বললেন ‘তোমরা এখন রনাঙ্গন ত্যাগ করো। তোমরা গেরিলা যোদ্ধা। তোমরা যে কোন উপায়ে রাঙ্গামাটি প্রবেশ করো। সেখানেই তোমাদের সাথে আমাদের দেখা হবে’। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
তার নিদের্শনা মোতাবেক আমি আর শামসুদ্দীন রনাঙ্গনের মাঠ ছেড়ে ফুরমোন পাহাড়ের এক সংর্কীণ পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে উপরে উঠতে থাকলাম। এখনো রণাঙ্গন থেকে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে গোধুলীর রক্তিম সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে। আমরা দু বন্ধু হাঁটছি জন-মানুষহীন জঙ্গলের পথ ধরে ফুরোমনের বুক চিরে। রাস্তা জঙ্গলে ভরা, ছন গাছে আচ্ছন্ন, কাঁটাওয়ালা জংলী গাছ ঠেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। রাত নেমে এসেছে। হাটঁতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। গন্তব্য কোথায় গিয়ে শেষ হবে কিছুই জানিনা। অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ এক আলোর ঝলক। আমরা থমকে দাড়ালাম। আমাদের হাতিয়ার কক করে যে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হলাম। একটা ছোট পাহাড়ি মাচাং ঘর। কাছে এগিয়ে গেলাম। মানুষের কথাবর্তা শোনা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে গৃহকর্তাকে ডাকতেই উনি সামনে এসে হাজির হলেন। উনি একজন চাকমা জুমিয়া। পরিবার নিয়ে থাকেন। আমাদের দেখে খুব ভয় পেলেন। পরিচয় দিয়ে বললাম ভয় নেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা। কুতুকছড়ি রনাঙ্গন থেকে এসেছি। উনি জানালেন এই এলাকায় কোন পাক-সেনা নেই। কোন দিন তারা এই এলাকায় আসেনি। রাতে থাকার অনুমতি চাইতেই তিনি সোৎসাহে একটা মোরগ জবাই করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। শুধুমাত্র ধনিয়া পাতা আর কাঁচা মরিচ দিয়ে রান্না করা সেই মোরগ গোশত আর গরম ভাত ছিলো আমাদের কাছে অমৃত। রাতে বিছনায় গা এগিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। কোন সময় ভোর হলো টেরই পেলাম না। সকালে গৃহকর্তা আর গৃহকত্রীকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে সেই মেঠোপথ ধরে কাউখালী বাজারের দিকে এগুতে থাকলাম।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাস্তা শেষে কাউখালী বাজারে পৌঁছার আগে পাহাড়ের পাদদেশে নেমেই একজন চাকমা ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেই তিনি জানালেন গত রাতে কাউখালী বাজারে যত রাজাকার ছিল সবাই পালিয়েছে। আমরা বাজারের দিকে এগুতে থাকলাম। দেখি ওখানে বেশ কিছু লোকের জটলা। আমাদের দেখা মাত্র ওরা ছুটে এল। জানালো গতকাল বিকালে ঢাকার রেস কোর্স ময়দানে পাকসেনা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসর্ম্পন করেছে। কাউখালী বাজারে কোন পাক সেনা ছিলনা এবং রাজাকাররা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে। আর কাল বিলম্ব না করে আমি আর শামসুদ্দীন পায়ে হেঁটে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাঙামাটিগামী সিএন্ডবি বিভাগের একটা মিনিট্রাক এসে পৌঁছলো। আমরা তাতে সওয়ার হলাম। মানিকছড়ি এসে ভাঙ্গা ব্রিজ দেখে নেমে পড়লাম। বুঝলাম গতরাতে পাকবাহিনী পালানোর সময় ব্রীজটি ধ্বংশ করে গেছে। ভোর সকালে মানিকছড়ি জন-মানব শুন্য।
আমাদের গাড়ি এগুতে থাকলো। কলেজ গেট এসে কিছু তিব্বতীয় সৈনিক দেখতে পারলাম। কিছুদুর এগিয়ে যেতেই মেজর সুরীকে দেখলাম কারো কাছ থেকে মোটর সাইকেল যোগাড় করে রাঙামাটি শহর চষে বেড়াচ্ছেন। আমি সংকেত দিয়ে তাকে থামালাম। তিনি জানালেন গত রাত পাকসেনারা রনে ভঙ্গ দিয়ে কুতুকছড়ি রনাঙ্গন থেকে পালিয়ে সদলবলে রাঙামাটি ছেড়ে পালিয়েছে। এখন তিনি রাঙামাটি শহর সম্পূর্ণ শত্রু মুক্তকরণে ব্যস্ত এবং তার কোম্পানির সৈনিকদের সংগঠিত করছেন। তার সাথে পরে যোগাযোগ করার নিদের্শ দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। রাঙ্গামাটির রাস্তা জনশুন্য। আমরা এগুতে থাকলাম। উপস্থিত হলাম জেলা প্রশাসকের অফিস প্রাঙ্গণে (পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং)। জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব থাকা এক কর্মকর্তার দেখা হলো। পরিচয় দিলাম। ততক্ষণে অন্যান্য কর্মকর্তারা হাজির হলেন। অনুরোধ করলাম একটা বাংলাদেশের পতাকা জোগাড় করে নিয়ে আসার জন্য যাতে আমরা সকলে মিলে উত্তোলন করতে পারি।
মহুর্তের মধ্যে পুরো শহরে খবর ছড়িয়ে পড়লো রাঙামাটি শহর হানাদার মুক্ত এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাঙামাটি দখল করেছেন। তারা এও জানলেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাঙামাটির এক সন্তান রয়েছেন যার নাম বাচ্চু অর্থাৎ মনীষ দেওয়ান। মাঝিবস্তীর ছেলে। জনতার ঢল নামলো। পাহাড়ি বাঙ্গালি, ছোট-বড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে এসেছে। প্রথমে শত, তারপর হাজারো জনতার ভীড়ে কোর্ট বিল্ডিং এলাকা কানায় কানায় ভরে উঠলো। সবার সাথে কর-মর্দন আর আলিঙ্গণে আমি মোহিত হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে উপস্থিত হলেন। হাজারো পাহাড়ী বাঙ্গালী জনতার করতালি আর গগণ বিদায়ী ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনিতে মুখরিত এই অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশে আমি আর শামসুদ্দীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলাম।
আমার দুচোখে তখন আনন্দের অশ্রুবন্যা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী।
(মণীষ দেওয়ান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। বর্তমান রাঙামাটি জেলা বিএনপির সদস্য। ১৯৫২ সনের ১০ ফেব্র“য়ারী রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলায় জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা প্রয়াত বিমলেশ্বর দেওয়ান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাঙামাটির প্রথম পুলিশ সুপার। মণীষ দেওয়ান ১৯৭১ সনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে স্বাধীনতা ঘোষনা শোনে তরুন বয়সে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সনে ১৭ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকারীদের মধ্যে তিনি একজন। ১৯৯৭৫ সনে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন, সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি খুলনা বিডিআর সেক্টর কমান্ডার ও দুটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সনে সেনাবাহিনীর কর্নেল পদে থাকা অবস্থায় মণীষ দেওয়ান স্বেচ্ছায় অবসরে যান। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ২ সন্তানের জনক।)