মোঃ মোস্তফা কামাল, বিশেষ প্রতিনিধি, রাঙামাটি। দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ হ্রদ কাপ্তাই হ্রদ হতে কাঙ্খিত পর্যাযে মাছের উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না । যথাযথ পরিচর্যার অভাবে হ্রদে ৬ প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটেছে । বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরো ৬ প্রজাতির মাছ। সুস্বাদু কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন রয়েছে ক্রম হ্রাসমান পর্যায়ে । বিনষ্ট হয়ে গেছে হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের ৪ টি প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র । হ্রদে বিগত বছর গুলোতে বার্সিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও অপেক্ষাকৃত ছোট প্রজাতির মাছের আধিক্যের কারনে তা রাঙামাটি বাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। কাপ্তাই হ্রদের ভবিষ্যৎ নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানা শংকার।
৭২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকার কাপ্তাই হ্রদের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিএফডিসিকে দেয়া হয় ১৯৬৪ সালে । ১৯৬৫ সাল থেকেই শুরু হয় বানিজ্যিক ভিত্তিতে কাপ্তাই হ্রদ হতে মাছ আহরন। কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদের উপর গবেষনার জন্য ১৯৮৫ সালে রাঙামাটিতে স্থাপিত হয় মৎস্য গবেষনা কেন্দ্রের নদী উপকেন্দ্র। পাশাপাশি মৎস্য বিভাগ ও বিভিন্ন সময় কাপ্তাই হ্রদেও উন্নয়নে কাজ করে। ফলে একাধিক সস্থার তত্বাবধানে কাপ্তাই হ্রদ পরিচালিত হলেও হ্রদের মূল দায়িত্ব বিএফডিসি কর্তৃপক্ষের।
বানিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য আহরনের পর থেকে কাপ্তাই হ্রদে পরিচালিত গবেষনার ভিত্তিতে হ্রদে ৭৫ প্রজাতির মাছের অবস্থান এবং ২ ধরনের চিংড়ি ও ২ ধরনের কচ্ছপ প্রজাতির অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। বানিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য আহরনের প্রথম দিকে এমনকি নব্বই দশকের মাঝামাঝিতেও কাপ্তাই হ্রদের আহরিত মাছের একটি বড় অংশ ছিল কার্প জাতীয় মাছ । কিন্তু সেই কার্প প্রজাতির মাছের উৎপাদন এখন ক্রম হ্রাসমান পর্যায়ে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা কেন্দ্র, রাঙামাটি নদী উপকেন্দ্রের সর্বশেষ (২০০৩) এর গবেষনা রিপোর্ট অনুযায়ী ৭৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে বর্তমানে ৬ টি প্রজাতির মাছ এখন কাপ্তাই হ্রদ হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে চিলন, দেশী স্বরপুটি, ঘাউড়, বাঘা আইড়, মেহেনী বাটা এবং দেশী পাঙ্গাস। বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরো ৬ প্রজাতির মাছ । এগুলো হচ্ছে দেমী মহাশোল, মধূ পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলসা ও সাদা ঘটিয়া । বেষনার রিপোর্টে বলা হয়েছে হ্রদে কার্প জাতীয় মাছ বিশেষ কওে রুই, কাতলা মৃগেল এর পাশাপাশি বাঁচা, পাতি পাবদা এবং চিতল মাছের উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, রাঙামাটি কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত গত ৫ বছরের মৎস্য আহরনের তালিকায় দেখা গেছে হ্রদ হতে বর্তমানে ৪৪ প্রজাতির মাছ বানিজ্যিক ভাবে আহরিত হচ্ছে। আহরিত মাছের একটি বড় অংশই ছোট প্রজাতির মাছ চাপিলা, কেচকি, গুড়া মইল্লা । বড় মাছের মধ্যে রয়েছে কালি বাউস, তেলা পিয়া, আইড় প্রজাতির মাছ।আহরনকৃত মাছের তালিকা অনুযায়ী গত তিন বছরে কাপ্তাই হ্রদ হতে কৈ, মহাশোল, স্বরপুটি, রাজপুটি, কার্পিও, মাগুড়, পোয়া, ফাইস্যা, চেলা, চান্দা বিগহেড কাকিলা প্রজাতির মাছ আহরনের পরিমান শুণ্যের কোটায়।
মৎস্য গবেষা কেন্দ্রের মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন কাপ্তাই হ্রদের ৪ টি স্থান ছিল কার্প জাতীয় মাছের প্রাকিৃতিক প্রজনন কেন্দ্র। বর্তমানে এই ৪ টি প্রজনন ক্ষেত্রই বিনষ্ট হয়ে গেছে। ফলে কার্প জাতয়ি মা মাছ প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়তে পাছেনা। যার প্রভাব পড়ছে কাপ্তাই হ্রদে । ধীরে ধীরে কমে আসছে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন। বিকল্প উপায় হিসাবে বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে প্রতিবছর হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের পোনা অবমুক্ত করা হলেও তা খুব একটা প্রভাব ফেলছেনা হ্রদের কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে।
মৎস্য গবেষনা কেন্দ্রের মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র গুলো পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।স কাচালং চ্যানেল, বরকল চ্যানেল, চেঙ্গী চ্যানেল এবং রিংক্ষং চ্যানেল এই ৪ টি প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র গুলো পুনরুদ্ধার করা গেলে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী তারা।
কাপ্তাই হ্রদ হতে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির যে ৯ হাজার মেট্টিক টন মাছ আহরিত হচ্ছে তা কাংখিত পর্যায়ের নয় বলে জনা গেছে। গত ১৭ মে রাঙামাটিতে মৎস্য মন্ত্রীর উপস্থিতিতে কাপ্তাই হ্রদেও উপর নির্ভরশীর দরিদ্র জেলে পরিবারের সদস্যদের ভিজিএফ কার্ড বিতরনী অনুষ্ঠানে মৎস্য গবেষনা কেন্দ্রে একজন পরিচালক কাপ্তাই হ্রদের আয়তন এবং বর্তমান প্রাকৃতিক অবস্থান অনুযাযী কাপ্তাই হ্রদকে মাছের উৎপাদনের জন্য মধ্যম প্রজাতির মৎস্য উৎপাদনে সক্ষম হিসাবে উল্লেখ করা হয় । গবেষনা অনুযায়ী এই হ্রদে প্রতি বছর ৩১ হাজার মেট্টিক টন মৎস্য সম্পদ থাকার কথা। প্রতি বছর তার অর্ধেক আহরিত হলেও এই হ্রদে বার্ষিক আহরিত মাছের পরিমান কমপক্ষে ১৫ হাজার মেট্টিক টন হওয়া উচিত। সে হিসাবে এখনো কাংখিত পর্যায়ের উৎপাদনের চাইতে ৬ হাজার মেট্টিক টন পিছনে রয়েছে কাপ্তাই হ্রদ। লাখো রাঙামাটি বাসীর চোখের জল দিয়ে তৈরী এই কাপ্তাই হ্রদেও মৎস্য সম্পদেও এই করুন পরিনতি কেন? কেনই বা হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ? কেনই বা ক্রমহ্রাসমান পর্যায়ে রয়েছে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন ? সরকার যেখানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে একের এক উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছে কাপ্তাই হ্রদেও মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির জন্য । রেকর্ড সংখ্যক ১৯ হাজার জেলেকে ভিজিএফ কার্ডের আওতায় এনে শত শত মেট্টিক টন খাদ্য শষ্য প্রদান করা হচ্ছে ।
কাপ্তাই হ্রদেও বর্তমান অবস্থার জন্য অনেকেই হ্রদ ব্যবস্থাপনা কারী কর্তৃপক্ষকে দায়ী করলে ও হ্রদের মৎস্য সম্পদের বর্তমান অবস্থার কারন হিসাবে নির্বিঘেœ মা মাছ মাছ ধ্বংস, হ্রদ ক্রমাগত দূষনের শিকার হওয়া, হ্রদে কেচকি জাল এবং কারেন্ট জালের ব্যবহার আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়াকে দায়ী করেছে। পাশাপাশি কাপ্তাই হ্রদের বিভিন্ন স্থানে হ্রদের পানিতে বিভিন্ন ধরনের জাক সৃষ্টি করে অতি মুনাফার উদ্দেশ্যে মাছের চাষকেও দায়ী করা হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদের মূল ব্যবস্থপানার দায়িত্ব বিএফডিসির হলেও হ্রদের বিভিন্ন স্থানে বিএফডিসির মতামত ছাড়াই অন্যান্য কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন ও আশংকা জনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি রাঙামাটিবাসীর মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় হ্রদ হতে মাছ আহরন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষযটিও উল্লেখ করা হচ্ছে।