শিরোনামঃ

পার্বত্য জনসংহতি সমিতির ৩দিন ব্যাপী সম্মেলন সমাপ্ত

সন্তু লারমা সভাপতি উষাতন সহ সভাপতি এবং প্রণতি সম্পাদক নির্বাচিত

সিএইচটি টুডে ডট কম ডেস্ক। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১০ম কেন্দ্রীয় সম্মেলন রোববার শেষ হয়েছে। ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করুন’ এই

সভাপতি পদে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সহ সভাপতি পদে উষাতন তালুকদার এবং সাধারণ সম্পাদক পদে প্রণতি বিকাশ চাকমা নির্বাচিত

সভাপতি পদে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সহ সভাপতি পদে উষাতন তালুকদার এবং সাধারণ সম্পাদক পদে প্রণতি বিকাশ চাকমা নির্বাচিত

শ্লোগানকে সামনে রেখে গত ৬ মার্চ তিনদিন ব্যাপী রাঙামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১০ম জাতীয় সম্মেলন শুরু হয়।
সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা, থানা ও ইউনিয়ন শাখাসমূহ এবং এর সহযোগী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি ও গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠীর সাড়ে তিন শতাধিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক যোগদান করেন।
জাতীয় সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ১০ম কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি পদে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সহ সভাপতি পদে উষাতন তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক পদে প্রণতি বিকাশ চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে শক্তিপদ ত্রিপুরা নির্বাচিত হয়েছেন। উল্লেখ্য, নব নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির ৩১ সদস্যের মধ্যে ২৯ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাকী দু’টি সদস্যপদ শূন্য রাখা হয়। পরবর্তীতে সুবিধা মত সময়ে এই শূন্য পদ পূরণের জন্য জাতীয় সম্মেলন নব নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটিকে দায়িত্ব অর্পণ করে।
সম্মেলনে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক একটি সামগ্রিক প্রতিবেদন পেশ করা হয় এবং উপস্থাপিত সামগ্রিক প্রতিবেদনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনসহ জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ, পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা, পার্টির ভবিষ্যত কর্মপন্থার উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে প্রতিনিধিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনরায় আসীন হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হওয়ায় চরম ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সরকার একদিকে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তালবাহানা করে চলেছে, অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্মস্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করে চলেছে যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূল করা এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা বলে সম্মেলনের প্রতিনিধিরা মত ব্যক্ত করেন।

সম্মেলনে প্রতিনিধিরা আরো বলেন, দেশের শাসকগোষ্ঠী একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থীদের মদদ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং অন্যদিকে সেটেলার বাঙালিসহ সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা, জুম্ম নারীর উপর হত্যা ও ধর্ষণ, অবাধে অব্যাহত অনুপ্রবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। ফলে জুম্ম জনগণ এক নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আগামী ৩০ এপ্রিল ২০১৫-এর মধ্যে সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ১ মে ২০১৫ সাল থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সরকার এখনো দৃশ্যমান ক্ষেত্রে এগিয়ে না আসায় প্রতিনিধিরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকার এগিয়ে না আসলে পূর্ব ঘোষণা অনুসারে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার জন্য সম্মেলনের প্রতিনিধিবৃন্দ দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

DSC00702এছাড়া সম্মেলনে একদিকে লাগাতার অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমার আঘাতে দগ্ধ হয়ে, অন্যদিক তথাকথিত ক্রসফায়ার, গুম ও গুপ্ত হত্যায় অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটায়; সর্বোপরি সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে আদিবাসীসহ সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনা-পর্যালোচনার পর বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নিমোক্ত প্রস্তাবাবলী সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়-

 

১. সরকার কর্তৃক সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবীকে সামনে রেখে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের উপর প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন অধিকতরভাবে জোরদার করা-
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা প্রণয়ন পূর্বক এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।
(খ) পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হস্তান্তর করা;
(গ) ২০ জানুয়ারি ২০১৫ অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় গৃহীত সুপারিশ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন পূর্বক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা;
(ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অপারেশন উত্তরণসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা;
(ঙ) প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী, আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও জনসংহতি সমিতির সদস্যদের যথাযথ পুনর্বাসন করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসসহ সকল প্রকার অপতৎপরতা নির্মূলীকরণের কার্যক্রম জোরদার করা।
৩. ৩০ এপ্রিল ২০১৫-এর মধ্যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে পূর্ব ঘোষণা অনুসারে ১ মে ২০১৫ সাল থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করা।
৪. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি জোরদার করা।
৫. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ করার কার্যক্রম জোরদার করা।
৬. দেশের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে অধিকতর সামিল হওয়া।
৭. দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রতিরোধ আন্দোলনে অধিকতর শরিক হওয়া।
৮. দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সারা বিশ্বের আদিবাসী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আরও শরিক হওয়া।
৯. দলীয় নীতি-আদর্শে অধিকতর সজ্জিত হয়ে পার্টি নেতৃত্বকে শক্তিশালী করা।
১০. দলীয় নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে গণ সংগঠন, কর্মী সংগঠন ও পরিবার সংগঠন জোরদার করা।
১১. পার্টির সদস্যপদ সংগ্রহের কার্যক্রম জোরদার করা এবং পার্টির নি¤œস্তরের কমিটি ও শাখা/ইউনিটসমূহের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়ের কাজ জোরদার করা।
১২. ছাত্র-যুব ও নারী সমাজকে আন্দোলনে সামিল করার লক্ষ্যে ছাত্র-যুব ও নারী সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার করা।
১৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কর্মরত জুম্ম শ্রমিক ও কর্মজীবীদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজ জোরদার করা।
১৪. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণকে অধিকতর উৎপাদনে উৎসাহিত ও সচেতন করা।
১৫. পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকতর অনগ্রসর জুম্ম জাতিসমূহের শিক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা।
১৬. জুম্ম জনগণের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চয়তা বিধানসহ ভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা।
১৭. জুম্ম জাতিসমূহের স্ব স্ব রীতিনীতি, প্রথা ও সামাজিক আইন সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
১৮. পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের উপর অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করা।
১৯. ক্যাম্প সম্প্রসারণ, অবৈধভাবে ইকো-পার্ক ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা, বহিরাগতদের পুনর্বাসন ইত্যাদির নামে জুমভূমিসহ স্থায়ী অধিবাসীদের রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়গা-জমি অধিগ্রহণ ও বেদখলের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২০. ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত গৃহীত বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী সিদ্ধান্তাবলী প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২১. ২৮ আগস্ট ২০১৪ তারিখে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পর্যটন (স্থানীয়) বিষয়টির উপর সম্পাদিত ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি বাতিল পূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক যথাযথভাবে হস্তান্তর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
২২. ৪ মার্চ ২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীপরিষদ কমিটির সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটন সংক্রান্ত গৃহীত সকল সিদ্ধান্ত বাতিল করার কার্যক্রম গ্রহণ করা।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 1,363 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen