শিরোনামঃ

রাজাকারের ছেলে কেনো সার্কেল চীফ? রায় পরিবারে আর কেউ নেই : প্রীতম রায়

প্রবাদে আছে ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’। কালের বিবর্তনে প্রবাদটির বাস্তব রূপ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন স্ব-ঘোষিত রাজার বেলায়। এরা নিজেরা নিজেদেরকে রাজা বললেও আইন অনুযায়ী এদের প্রকৃত পদের নাম ‘সার্কেল চিফ’। ব্রিটিশ শাসনামলে চিটাগাং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০ আইন বা চিটাগাং হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল এর ক্ষমতাবলে এই পদের সৃষ্টি হয়।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি সার্কেল বা অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলেও তারা ‘সার্কেল চিফ’ নামেই অভিহিত হয়ে আসছে। শান্তিচুক্তিতেও তাদের সার্কেল চিফই বলা হয়েছে। কিন্তু নিজ সার্কেলে বসবাসকারী জনগণের কাছে তারা নিজেদেরকে রাজা বলেই পরিচয় দেয়। যা (Chittagong Hill Tracts Regulation 1/1900) চিটাগাং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন- এর ৩৫ নং আইন এবং অন্যান্য বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিধিসম্মত নয়।
সম্প্রতি রাঙামাটি অঞ্চলের সার্কেল চিফ বা কথিত রাজা দেবাশীষ রায় পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে তার বিভিন্ন অপতৎপরতার কারণে আলোচনায় আসলেও একজন আত্মস্বীকৃত কুখ্যাত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্র হয়েও রাঙামাটি অঞ্চলের সার্কেল চিফ হওয়া নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক অনেক পুরনো।

উত্তরাধিকার সূত্রে একজন পাকিস্তানি ও রাজাকার হবার কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর অস্বীকৃতির কারণে দেবাশীষ রায়ের বাবা ত্রিদিব রায়ের কোনো আত্মীয়কে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজা বা সার্কেল চিফ করা হয়নি। তবে ১৯৭১ সালে ত্রিদিব রায় স্বাধীনতার বিরোধীতা করে পাকিস্তান চলে যাওয়ার পর রাজার দাায়িত্ব ত্যাগ করলে অলিখিত ও মৌখিকভাবে তার ছেলে দেবাশীষ রায় সেই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেবাশীষ রায়কে ৫১তম রাজা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজার সিংহাসনে বসানো হয়।
রাজা দেবাশীষ রায়ের বাবা প্রয়াত ত্রিদিব রায় রাঙামাটি সার্কেলের ৫০তম চাকমা রাজা ও সার্কেল চিফ ছিলেন। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর ত্রিদিব রায়ের বাবা রাজা নলিনাক্ষ রায় মারা গেলে ১৯৫৩ সালের ২ মার্চ সিংহাসনে বসেন ত্রিদিব রায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়- তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী একজন আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের আমৃত্যু দপ্তরবিহীন মন্ত্রী।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধু প্রবল বিরোধিতাই নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ায় তিনি রাগে, ক্ষোভে ও ভয়ে রাজ্য ও রাজত্ব ছেড়ে পালিয়ে তার প্রিয় রাষ্ট্র পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তান তাকে অবমূল্যায়ন করেননি। আমৃত্যু দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর মর্যাদা দান করেছিল তাকে। এজন্য তাকে বলা হতো পাকিস্তানের উজিরে খামাখা! ৪২ বছর ইসলামাবাদেই ছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানেই মারা যান রাজা ত্রিদিব রায়।

দেবাশীষ রায়ের বাবা প্রয়াত রাজা ত্রিদিব রায়ের আমলনামা ঘেঁটে জানা যায়, পাকিস্তান প্রেমের কারণে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার বিরোধিতা করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দেন। ১৯৭০- এর দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি পাকিস্তান সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আহ্বান জানালেও পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রপতি হতে না পারার কারণে ত্রিদিব রায় তা গ্রহণ করতে পারেননি।
প্রিয়জিৎ দেব সরকারের লেখা ‘দ্য লাস্ট রাজা অব ওয়েস্ট পাকিস্তান’ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর মে মাসে তিনি রিজার্ভ বাজার এবং তবলছড়ি বাজারে জনসভায় ভাষণ দেন। এসব জনসভায় তিনি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের দামামার মধ্যেও পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র চষে বেড়ান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ত্রিদিব রায় আর বাংলাদেশে আসেননি। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের যোগদানের আবেদনের বিরোধীতা করার জন্য পাকিস্তান প্রেরিত প্রতিনিধি দলেও ত্রিদিব রায় প্রধান ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রণীত দালাল আইনে তার নাম ছিল।

১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ত্রিদিব রায় বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আর্জেন্টিনা, শ্রীলঙ্কা, চিলি, ইকুয়েডর, পেরু ও উরুগুয়ের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করার পর তিনি চূডান্তভাবে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি সেদেশের এম্বাসেডর এট লার্জ ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান বুড্ডিস্ট সোসাইটির প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে রাজা ত্রিদিব রায়ের দেশে ফেরার আবেদন প্রথম বাংলাদেশকে জানানো হয়। ২০০৫ সালে বিএনপির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান ওই প্রস্তাব অনুমোদন করলেও রহস্যজনক কারণে তিনি বাংলাদেশে আসেননি। দীর্ঘদিন পর ২০১০ সালের শেষার্ধে ওই আবেদন আবারো আলোচনায় আসে। ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুর পর ওই লাশ ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে পাকিস্তান। যে পাকিস্তান প্রেমের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন নিজের মাতৃভূমি, ত্যাগ করেছেন রাজত্ব, সেই পাকিস্তানেই হয়েছে তার শেষ ঠিকানা। লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি যুদ্ধাপরাধী ও আজীবন পাকিস্তানের মন্ত্রী ত্রিদিব রায়ের মরদেহ।
২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের এক আদেশে ৯০ দিনের মধ্যে সব স্থাপনা থেকে তার নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন, কেননা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় কোনো রাজাকারের নামে বাংলাদেশে কোনো স্থাপনা না থাকার বিধান রয়েছে। এরপর থেকে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে দেবাশীষ রায়ের বাবা আত্মস্বীকৃত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের নাম। উঠে এসেছে একাত্তরে তার জঘন্য ভূমিকার নানা ইতিহাসও।

জানা যায়, রাঙামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার পরও রাঙামাটিকে শত্রুমুক্ত করতে একাত্তরের ১৬ এপ্রিল মহালছড়ি থেকে রাঙামাটিতে নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে। যার ফল তিনি পেয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসার আগেই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তা টের পেয়ে স্থানীয় চাকমাদের বিরোধীতা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে সাথে পাকিস্তানি কয়েকজন জুনিয়র অফিসারকে নিয়ে আসেন এবং বৈঠকের নির্দেশনা অনুযায়ী একই সাথে কাপ্তাই থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল কয়েকটি লঞ্চ ও স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়।

এসডিও আবদুল আলীর সাথে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে তারা।
একপর্যায়ে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই রাঙামাটি দখল করে নেয় পাক হানাদাররা। সেই এসডিও আবদুল আলীর পরিণতি হয়েছিল মর্মান্তিক।

শরবিন্দু শেখর চাকমার ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে রাঙামাটি পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে আবদুল আলীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিয়ে সেসব জায়গায় লবণ দেয়া হয়েছিল। এরপর তাকে একটি জিপের পেছনে বেঁধে টেনে রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়’। রাজাকার ত্রিদিব রায় তার নিজের আত্মজীবনী ‘ডিপার্টেড মেলোডি’তেও এ ঘটনার স্বীকারোক্তি তুলে ধরেছেন।

গত বছর সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী প্রয়াত ত্রিদিব রায়ের পুত্র দেবাশীষ রায় কী করে রাঙামাটির বর্তমান সার্কেল চীফ হলো তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। কেননা একদিকে যুদ্ধাপরাধী এবং অন্যদিকে স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পদে বহাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের আনুগত্য স্বীকারকারী পাকিস্তানি নাগরিকের সন্তানকে সার্কেল চীফ ও রাজা হিসেবে মেনে নেয়া বাংলাদেশিদের জন্য অসম্মান, লজ্জার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী।

এদিকে চাকমা রাণী তাতু রায় ১৯৯৮ সনে মৃত্যুর পর দেবাশীষ রায় আর বিয়ে করেননি, হঠাৎ দেখা যায় ২০১৩ সনের ১২ ডিসেম্বর রাজা দেবাশীষ রায় ও য়েন য়েন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকালে দুজনেই অংটি বদলসহ বিবাহ বন্ধনের কথা ঘোষনা করেন এবং ২০১৪ সনের ৪ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। চাকমা সার্কেলের চীফ হিসেবে দেবাশীষ রায় চাকমা সম্প্রদায়ের মেয়ে বিয়ে করার কথা থাকলেও তিনি মারমা সম্প্রদায়ের মেয়ে বিয়ে করেছেন। এটি নিয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের মাঝে চাপাও ক্ষোভও রয়েছে।

 

নোট: লিখাটি লেখকের একান্ত ব্যাক্তিগত।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 2,177 বার পঠিত হয়েছে


Subscribe to Comments RSS Feed in this post

3 Responses

  1. Copied from banglanews.com OK
    Debashis ray didn’t do nothing against Bangladesh. Remind it.
    He is pride of Chakma nation. Treediv Ray gained chance to be President of Pakistan. May be Pakistan is foe of Bangladesh. But it is also a fact of proud for chakma nation that he may a President of a country Pakistan. He was a brilliant Chakma and very good leader and King of Chakma.

  2. NOT Copy Right!
    Because the author has Been Emailed
    And the editor added some new information.
    So Not Copy Right B anglanews.com
    OK.
    & You understand what you have heard from history.

  3. NOT Copy Right!
    Because the author has Been Emailed
    And the editor added some new information.
    So Not Copy Right B anglanews.com
    OK.
    & You understand what you have heard from history.

Leave a Reply to Shah Alam Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen