সিএইচটি টুডে ডট কম,খাগড়াছড়ি। আয়েসী জীবনের জলমলে দিন, বিলাসবহুল গাড়ী-বাড়ী সবই আছে, তাঁদের। কিন্তু ভোটের মৌসুমে ‘হলফনামা’ দিতে গিয়েই সবাই হয়ে পড়েন, গরীব ও ঋণগ্রস্ত। অনেকে হলফনামায় সম্পদ গোপনের পাশাপাশি দিয়েছেন মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য।
জেলার ৬টি উপজেলার নির্বাচনে বিশেষ করে ২৫ চেয়ারম্যান পদ-প্রার্থীর হলফনামায় দেখা গেছে, মাত্র চারজন-ই শুধু ‘টাকার কুমির’।
তাঁরা হলেন রামগড়ের বেলায়েত হোসেন ভূইয়া, তাঁরই ভাতিজা শহীদুল ইসলাম ভূইয়া, মাটিরাঙ্গা আবুল কাশেম এবং সদরের রেজাউল করিম হেলাল।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশী অর্থ-বিত্তের মালিক এক সময়কার বাঙ্গালী নেতা এস এম রেজাউল করিম হেলাল, তার পরের অবস্থানে আলোচিত ‘ভূইয়া’ পরিবারের বেলায়েত হোসেন ভূইয়া, ভাতিজা ফরহাদ এবং সবার শেষে আবুল কাশেম ভূইয়া। এর মধ্যে বেলায়েত ও ফরহাদ সর্ম্পকে চাচা-ভাতিজা।
এস এম রেজাউল করিম হেলাল
দৃশ্যত খাগড়াছড়িতে তিনি খুব ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত নন। একসময় ‘বাঙ্গালী কৃষক-শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে গুচ্ছগ্রাম ভিত্তিক রাজনীতি করতেন। ওয়াদুদ ভূইয়া’র সাথে গুচ্ছগ্রামের নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে দীর্ঘদিন খাগড়াছড়িতে না থাকায় তাঁকে জেলা সদরের মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছিলে।
কিন্তু আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দেয়া হলফনামায় তাঁর রাজধানী ঢাকায় বিপুল সম্পদের পরিমাণ জেনে মানুষ অবাক হয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম হেলাল ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৩’শ ৩০ ভোট নজির রয়েছে।
তাঁর স্থাবর সম্পদের মুল্যমান ৬ কোটি ২০ লক্ষ টাকা এবং অস্থাবর সম্পদের মুল্যমান সাড়ে ২২ লক্ষ টাকা। তবে সম্পদের তুলনায় তাঁর বাষিক আয় একে বারে কম। নিজের মাত্র ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা এবং নির্ভরশীলের মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
অর্জনকালীন সময়ের মুল্যমানে তাঁর স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ৯০ লক্ষ টাকার ১৫ বিঘা কৃষি জমি, ৩০ লক্ষ টাকার ৩ একর পাহাড়, ৮ শতক জায়গার ওপর ৪ কোটি টাকার টিনশেড আবাসিক/ বাণিজ্যিক বাড়ী এবং ২০ শতক জায়গার ১ কোটি টাকার এ্যাপার্টমেন্ট উল্লেখযোগ্য। তাঁর স্থাবর সম্পত্তির সবই তাঁর একক মালিকানায় বলেও হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এর মধ্যে বেশী দামী সম্পদের অবস্থান ঢাকার খিলক্ষেতের গোড়ান এবং মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে বলে জানা গেছে।
স্থাবর সম্পদের দিক দিয়ে ২৫ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে সবার ওপরে হলেও অস্থাবর সম্পদের দিক থেকে তিনি বেশ পিছিয়ে। তাঁর অস্থাবর সম্পদের অর্জনকালীন সময়ের মুল্য মাত্র সাড়ে ২২ লক্ষ টাকার।
এরম ধ্যে নগদ দেড় লক্ষ টাকা, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের ৬ লক্ষ টাকার স্বর্ণালংকার, নিজের ও নির্ভরশীলদের সাড়ে ৫ লক্ষ টাকার ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী এবং নিজের ও নির্ভরশীলদের ৪ লক্ষ টাকার আসবাবপত্র উল্লেখযোগ্য।
বেলায়েত ভূইয়া
নির্বাচন প্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন ভূইয়া’র রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে টানা ২০০৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ পাঁচ বার নির্বাচন করে রামগড় উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এক সময়কার তুখোড় জাসদ নেতা বেলায়েত ভূইয়া, জাতীয় পার্টি’র ঘাট মাড়িয়ে ভীড়েন বিএনপিতে। রামগড়ে আগের মতো তাঁর দোর্দন্ড প্রতাপ না থাকলেও জনপ্রিয়তা আছে এখনো।
‘ওয়ান-ইলেভেন’র সময়ে তিনি কর ফাঁকি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে মামলার পাশাপাশি জেলও খেটেছেন দীর্ঘদিন।
উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের অর্জনকালীন সময়ের মুল্য হচ্ছে সর্বমোট ২ কোটি ৬৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩’শ ৫০ টাকা।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকায় কেনা ৬.৮০ একর কৃষিজমি, ৪ লক্ষ ৬২ হাজার টাকায় কেনা ৩.৬৮ একর অকৃষি জমি, ৫৭ হাজার ২’শ ২৫ টাকায় কেনা একটি বাণিজ্যিক প্লট, ঢাকার ধানমন্ডিতে ৭ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকায় কেনা একটি প্লট, ১ কোটি ৫৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত খুলশী এলাকায় ৬ শতক জায়গার ওপর ছ’তলা বাড়ী এবং ৩২ লক্ষ ৯৫ হাজার ১’শ ২৫ টাকায় করা ৭.০৬ একর ভূমিতে বাগান ও খামার উল্লেখযোগ্য।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ২ লক্ষ নগদ টাকা, ১১ হাজার টাকার বন্ড অথবা শেয়ার, ২০ লক্ষ টাকা মুল্যের একটি কার, ৫ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা মুল্যের ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, স্ত্রী’র ১৯৮৩ সালে কেনা ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকায় কেনা ৩০ ভরি স্বর্নালংকার এবং ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা মুল্যের আসবাবপত্র ও ক্রোকারিজ উল্লেখযোগ্য।
বেলায়েত ভূইয়া’র দেয়া হলফনামায় তাঁর বার্ষিক আয়ের পরিমাণ, ৩ লক্ষ ৫০হাজার। এরমধ্যে কৃষিখাত থেকে ৮০ হাজার, ভাড়া থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার এবং অন্যান্য খাত থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার।
কিন্তু তাতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রাপ্ত বার্ষিক ২ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা ভাতার উল্লেখ ছিল না। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য এবং পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর এলাকার বিপুল সম্পত্তির কথা উল্লেখ করেননি।
ফেনী’র পৈতৃক সম্পদের হিসাব না দেয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, বন্টন নামা নিয়ে জটিলতা থাকায় তা দিতে পারেননি।
শহীদুল ইসলাম ভূইয়া ফরহাদ
রামগড় উপজেলা বিএনপি’র সাঃ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম ভূইয়া বয়সে তরুণ হলেও সম্পদের দিক থেকে বেশ এগিয়ে গেছেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি শাসনামলে তাঁর চাচা সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভূইয়া ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বোর্ড’র চেয়ারম্যান ছিলেন। এই সুবাদে বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন রাবার প্রজেক্টের ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক বনেছেন বলে কথিত আছে। ক্ষমতার শেষ মেয়াদে তিনি ভূয়া অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে ‘বিন্যাস’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক হন। জেল না খাটলেও তাঁর বিরুদ্ধে ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এ কর ফাঁকি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ের করা মামলার পাশাপাশি রয়েছে, অনেকগুলো ফৌজদারি মামলার খড়গ।
হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁর বর্তমান বার্ষিক আয় ১৪ লক্ষ ৬৭ হাজার ৬’শ ৭৪ টাকা।
অর্জনকালীন সময়ের দর হিসেবে তাঁর স্থাবর সম্পদের মুল্য প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ এবং অস্থাবর সম্পদের মুল্য সোয়া কোটি টাকারও বেশী। বর্তমান বাজার মুল্যে যা ১০/২০ গুণ বেশী হতে পারে।
ফরহাদের স্থাবর সম্পদের মধ্যে ২ লক্ষ টাকায় কেনা ০.০৬ একর কৃষিজমি, ৬ লক্ষ ১৩ হাজার ৭’শ ৭১ টাকায় কেনা ৬.৬৭ শতক অকৃষি জমি, স্ত্রী’র নামে ৮ লক্ষ টাকায় কেনা ৫ একর অকৃষি জমি, ১০ লক্ষ টাকায় কেনা ১টি বাণিজ্যিক ও ১টি আবাসিক প্লট এবং চট্টগ্রামের খুলশীতে ৯৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায় গড়ে তোলা ৬ তলা বাড়ী ‘রয়েল প্যালেস’ উল্লেখযোগ্য।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ৪৪ লক্ষ ৫৪ হাজার ২’শ ৫৮ টাকা নগদ, ব্যাংকে জমা ৬৭ হাজার টাকা, স্থায়ী আমানত ৪৫ লক্ষ টাকা, ১টি কার ও ১টি ট্রাকে ২৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, স্ত্রী’র নামে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় কেনা ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার, ২ লক্ষ ৫৬ হাজার ৫’শ টাকার ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, ৩ লক্ষ ৬ হাজার টাকার আসবাবপত্র, ‘বিন্যাস’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার মালিকানা এবং বিডি বিল্ডিংয়ের ৩০০০ (সংখ্যায়) শেয়ার উল্লেখযোগ্য।
তবে এই হিসেবে তাঁদের পৈতৃক এবং যৌথ মালিকানার অন্যান্য সহায়-সম্পত্তির বিবরণ দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
আবুল কাশেম ভূইয়া
দল-বদলে সিদ্ধহস্ত এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে পারঙ্গম আবুল কাশেম ভূইয়া। মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত তিনি টানা চারবারের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনিও একাধারে নির্বাচন প্রিয়। যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন, তিনি সে সরকারের দল-ই করেন। তাই সবক’টি দল তাঁর করা শেষ হয়েছে বিধায় এখন কোন দলে তাঁকে সক্রিয়ভাবে দেখা যায় না। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন বলে সাথে রেখেছেন একটি বৈধ নাইন শুটার গান।
বিপুল সম্পদের মালিক হলেও হলফনামা দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন।
ব্যবসা হিসেবে চট্টগ্রাম শহরের ধনিয়ালাপাড়া (কদমতলী)-র ৪/বি, ডি,টি রোডে ‘ঝর্ণা মোটরস্’ এবং ১০৪/এ ষোলশহরে ‘রুবি এন্টারপ্রাইজ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করলেও টাকার অংক রেখেছেন, উহ্য। তাঁর বার্ষিক আয় ২০ লক্ষ ৫২ হাজার ৭’শ ৯২ টাকা। আবার যার মধ্যে প্রায় পৌণে ৩ লক্ষ নির্ভরশীলদের আয়।
তাঁর স্থাবর সম্পদের অর্জনকালীন সময়ের মুল্য মোট ৬১ লক্ষ ৪৭ হাজার এবং অস্থাবর সম্পদের অর্জনকালীন মুল্য ৪৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ৪’শ ১২ টাকা।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে মাটিরাঙ্গার তবলছড়িতে নিজের নামে ৬ লক্ষ টাকার জায়গাসহ দ্বিতল বাড়ী, স্ত্রী’র নামে উপজেলা সদরে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মুল্যমানের দ্বিতল বাড়ী, নিজের নামে মাটিরাঙ্গা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ৫৩ লক্ষ ৩২ হাজার টাকার অকৃষি জমি এবং স্ত্রী’র নামে ৯৫ হাজার টাকার অকৃষি জমি উল্লেখযোগ্য।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নগদ ৮৫ হাজার ৩’শ ৮৫ টাকা, স্ত্রী’র কাছে নগদ ৭ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩১ টাকা, নিজের ব্যাংক হিসাবে ২ লক্ষ ১৫ হাজার ২’শ ৪২ টাকা, স্ত্রী’র হিসাবে ১৫ হাজার ২’শ ৫৪ টাকা, ১ লক্ষ টাকা দামের একটি নাইন শুটার গান, ২৫ তোলা স্বর্ণ (নিজের ও নির্ভরশীল) বাবত ৫৫ হাজার টাকা, আসবাবপত্র আর ইলেক্ট্রনিক্স মিলে মাত্র ৪০ হাজার ৫’শ টাকা।