শিরোনামঃ

খোলা জানালা

পার্বত্য চট্টগ্রাম , যেখানে জাতীয় রাজনীতি খুব বেশী পাল্টাতে পারেনি আঞ্চলিক রাজনীতির পুরোনো ধারাকে : প্রদীপ চৌধুরী

১৯৪৭ সালের উপমহাদেশ বিভক্তি’র আগে থেকেই বাংলা ভূখন্ডে জাতীয়তাবাদী, সাম্যবাদী, উগ্র, মধ্যপন্থা, সর্বহারা, সশস্ত্র, আন্ডার-গ্রাউন্ড, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক তরিকার নানা দর্শনের রাজনৈতিক দলের তৎপরতা দৃশ্যমান ছিলো।Prodip
১৯৪৮ সাল নাগাদ ভারত-পাকিস্তান দুটো পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরও এসব নানা ধাঁচের-চিন্তার রাজনৈতিক দলগুলোর বিলুপ্তি ঘটেনি। সীমানা ভাগ হয়ে দেশ আলাদা হয়ে গেলেও সবকটি রাজনৈতিক দল; নতুন করে সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু নীতি-আদর্শের খুব বেশী ব্যত্যয় ঘটেনি।
এমনকি একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতি’র পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তানেও বেশক’টি রাজনৈতিক দল সমান সক্রিয়তায় বেঁচে ছিলো।
এই সময়টাতে বর্তমানের পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উচ্চ শিক্ষিত কিংবা রাজনীতি সচেতন’ খুব বেশী মানুষ ছিলেন না। তবে, এ না থাকার মাঝেও যে ক’জন ছিলেন; তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন, কিভাবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’কে পাকিস্তানমুক্ত রাখা যায়। এক্ষেত্রে প্রয়াত ‘¯েœহ কুমার চাকমা’র নাম স্মরণযোগ্য।
এমন চেষ্টা তৎকালীন পূব ও পশ্চিম বঙ্গেও অখন্ডতায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরোধারাও করেছিলেন।
সে যাক, দুঃস্বপ্নের পাঁচালী।
অবশ্য ১৯৬০ সালে কথিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক জান্তা’র বাস্তবায়িত ‘কাপ্তাই বাঁধ’ বা ‘পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মানস দ্রুত পাল্টাতে থাকে।
এসময় মেধাবী তরুণদের একটি অংশ ঈশান কোণে মেঘের দেখা পেয়ে গর্জে উঠেন। কিন্তু সেসময় ভারত-পাকিস্তানের সীমানা বিরোধ, ধর্ম উন্মাদনা এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাব পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে বর্হিবিশ্বের যথাযথ মনোযোগ আকর্ষণ সম্ভব হয়নি।
এরপর সময় যতোই গড়িয়েছে, ততোই পাকিস্তান রাষ্ট্রের চেহারা-চরিত্র দিনের মতো ফকফকা হতে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের আম-জনতার কাছে। মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, কমরেড মনি সিংহ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীনদের মতো অসাম্প্রদায়িক-উদারপন্থী ব্যক্তিত্ব ছাড়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি বোঝার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পুরো পূর্ব পাকিস্তানেই খুব কম ছিলো।
সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবি-সাহিত্যিক এবং বাম তাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেকে থাকলেও তাঁরা কতোটা জন-আঙ্খাংকার কাছাকাছি ছিলেন, সেটিও বিবেচ্য বিষয় তখন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, তখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের গুটিকয় মানুষ সমতলের সমকক্ষ না হোক; বুঝতে পেরেছিলেন ধর্মবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যত বীভৎসতার মানচিত্র।
সময় আর রাজনীতির অর্নিবার্য্য বাস্তবতায় জন আন্দোলনের অনেকগুলো বাঁক পেরিয়ে সামনে এলো ১৯৭১ সালের ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’।
‘বাংলাদেশ’ নামের এই রাষ্ট্রের জন্মের সুদীর্ঘ ৯ মাসের জীবনযুদ্ধে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ সব তীর এক সূতোয় গাঁথা হয়েছিলো রক্তের নকশীকাঁথায়।
এখনকার মানচিত্র অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্বাংশের অনেক মানুষ, জাতি, গোষ্ঠি এবং সম্প্রদায় ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে শামিল হয়ে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেও কিছু কথা আবারো থমকে যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়।
যদি নাম না ধরেই বলি, এমন রাজাকার-স্বাধীনতা বিরোধী কিংবা মুসলিম লীগের চামচাগিরি; অনেকেই করেছেন। অনেকেই কবরস্থ হয়ে আছেন এই দেশে, যাঁরা জীবদ্দশায় এই দেশটি চাননি।
আবার এমনও জামাতী চিন্তার উত্তরাধিকারী বেঁচে আছেন; যাঁরা রাজাকার কিংবা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা চিন্তায়-মননে এবং কায়মনো কামনায় পাকিস্তানপন্থী! যাঁদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে¯œাত দেশে বসবাস করেন এবং সরকারের সুযোগ-সুবিধাও হাতিয়ে নিচ্ছেন। সম্ভবত, এই ধাঁচের জীবিত লোক সমতলের মতো পাহাড়েও কম নয়।
ভৌগলিক এবং দূর্গমতা বিবেচনায় অবিভক্ত উপমহদেশের সময়কাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে চীনপন্থী বিপ্লবীদের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন ঐতিহাসিকরা। একাত্তরের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুবকদের একটি বড়ো অংশ ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)’, বিপ্লবী রাজনীতি’র গুরু কমরেড আব্দুল হক, কমরেড তোয়াহা এবং কমরেড সিরাজ সিকদারের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেন। এরমধ্যে সর্বহারা’র হাত ধরে চোস্ত বিপ্লবী হয়ে উঠেন তারুণ্যের বড়ো একটি অংশ।
কথিত আছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কিছু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্র বাহিনীকে অনেকগুলো সন্মুখযুদ্ধ করতে হয়েছে, মিজো এবং চীনপন্থী সর্বহারাদের বিরুদ্ধে। এমনকি দেশ স্বাধীনের পরও সর্বহারা’র নীতিতে বিশ্বাসী সশস্ত্র সংগ্রামীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু’র অসীম আন্তরিকতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে সারাদেশের শত-সহ¯্র স্্েরাত ও চিন্তায় বিভক্ত মানুষরা স্বাধীনতা উত্তর দেশ গঠনের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।
সেই ডাক ১৯৭১ সালে যেমন পাহাড়কে ছুঁয়ে গিয়েছিলো। তেমনি ১৯৭৫ সালের ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামলিীগ (বাকশাল)’ গঠনের প্রক্রিয়াতেও দৃশ্যমান ছিলো।
যদিও ‘বাকশাল’ নামের দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে এখনকার মতো তখনও আলোচনা-সমালোচনা ছিলো। তবুও পাহাড় থেকে নির্বাচিত তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম. এন. লারমা)-সহ অনেকেই ‘বাকশাল’-এ যোগ দিয়েছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবসহ স্বজনদের একরাতে গণ-হত্যার মধ্য দিয়ে পাল্টে গেলো, দেশ পূর্নগঠনের স্বপ্ন এবং ভবিষ্যত।
আজ দেশ স্বাধীনের চার দশক পর আমরা যেসব ‘যুদ্ধাপরাধী’র বিচার দেখতে পাচ্ছি; পঁচাত্তরের পর তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন প্রিয় স্বদেশের পলিসি মেকার। তাঁরা না হয় তাঁদের নীতি-আদর্শে উচ্ছসিত উচ্ছিষ্টরাই দেশটি’র সংবিধানে ছুরি চালিয়ে ভাগ করে দিলো।
নেপথ্যে’র সাম্প্রদায়িক ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে বর্হিবিশ্বে কুখ্যাত সেসব অপরাধীদের বিচার সুসম্পন্ন হতে চলেছে।
নিশ্চয়ই পাহাড়ের দেশপ্রেমিক সকল মানুষও সেই সংবাদের জন্য উদগ্রীব।
কিন্তু কথা থেকে যায়, অনেক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বর্হিবিশ্বের সাথে বাংলাদেশের কানেক্টিভিটি; পুরো দেশের সম-সাময়িক রাজনীতিকে দ্রুত পাল্টে দিতে চললেও পাহাড়ের রাজনীতি কতোটা পাল্টাচ্ছে?
যদি বলি ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন থেকেই তিন পার্বত্য জেলায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখলেও সমতলের তুলনায় সে গণতন্ত্র এখানে কতোটুক শক্ত ভিত্তি’র ওপর দাঁড়াতে পেরেছে?
যদি বলি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমানে পার্বত্য জেলা পরিষদ), ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক ‘পার্বত্যচুক্তি’, ১৯৯৮ সালের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’ কিংবা সরকার ও দাতাগোষ্ঠি’র অসামান্য উন্নয়ন; কতোট সুফল এনে দিয়েছে জাতীয় রাজনীতিকে?
তিন পার্বত্য জেলায় যাঁরা জাতীয় রাজনীতি (আওয়ামীলীগ-বিএনপি) করেন, তাঁদের বর্তমান-অতীত সব দায়িত্বশীল নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, এই ব্যর্থতার দায়ভার কী সাধারণ জনগণের?
সেই ১৯৯১ সাল থেকেই আপনারা পদ-পদবী, এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী হবার সুবাদে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। আপনাদের বিত্ত-বৈভব, বাড়ী-বাগান-ব্যবসা-ভ্রমণ বিলাস তো পাহাড়-সমতলে, সবার কাছেই জানা।
আপনাদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক জীবনও বর্ণাঢ্য-অভিজ্ঞ এবং উচ্চ শিক্ষায় পরিপূর্ণ। তাহলে কেনো আপনাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে না?
জানি, আপনারা এসব প্রশ্নের উত্তরে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো’র অস্ত্রবাজী-চাঁদাবাজী এবং জাতীয়তাবাদী (এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা) উগ্রতাকে দোষ দিবেন।
তাহলে, এতো বছর ধরে সরকার (জাতীয় পার্টি-বিএনপি-আওয়ামীলীগ) আপনাদের হাত দিয়েই এইযে উন্নয়ন, এইযে দান-খয়রাত, এইযে চাকরি-বাকরি, এইযে উচ্চশিক্ষার কোটা-বৃত্তি; বছরের পর-যুগের পর যুগ দিয়ে যাচ্ছে, এটার মানে কী?
এটার সোজা উত্তরঃ আপনারা জনগণের মনোজগতে ভিত্তি গড়তে অসফল হয়েছেন অথবা নিজোরা জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য-জনপ্রিয় হবার মতো কৌশল নিতে পারেননি।
যদি আপনারা বুঝতেই পারেন, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের শক্তি (অস্ত্র ছাড়া) আপনাদের জাতীয় রাজনীতির চেয়ে বেশী তাহলে সময় উপযোগী কৌশল নিচ্ছেন না, কেনো?
একসময় দেশের সবক’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জাসদের বিপ্লবী রাজনীতি’র জোয়ার বয়েছিলো। সময়টি তখন, যখন বঙ্গবন্ধু’র জনপ্রিয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার লোক কমই পাওয়া যেতো।
সেই ‘জাসদ’-ই রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনামলে ভেঙ্গে পড়েছিলো, হুড়মুড় করে। সেই ‘জাসদ’ সেই ‘গণ-বাহিনী’র হাতে অনেক অস্ত্র ছিলো, ছিলো বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা’র বিপ্লবী জ্ঞানযোদ্ধাও।
সেই ‘জাসদ’ও আজ আওয়ামীলীগ-বিএনপি শুধু নয়, জামাত-জাতীয় পার্টিতেও ভিড়েছে।
আর আপনারা জাতির পিতার হাত ধরে কেউ মুক্তিযুুদ্ধের অগ্রসৈনিক, কেউ পিতা হত্যা’র বিচার দাবীতে দেশত্যাগে বাধ্য, জেল খেটেছেন অনেকবার। আবার কেউ পাহাড়ের যুদ্ধকালী সময়ে ‘শান্তিবাহিনী’র মৃত্যু পরোয়ানা বয়ে বেড়িয়েছেন। কেউ অতীতে এবং বর্তমানেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন বড়ো দলের বড়ো পদে অধিষ্ঠিত হয়ে। আবার কেউ জীবন বাজি রেখে নির্বাচন করেছেন, জিতেছেন নয়তো হেরেছেন। এখনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন রাজনীতি’র বাইরের সামাজিক-বাণিজ্যিক অনেক কাজেই।
তাহলে কী আপনারা, আপনাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে রেখে যাবেন, ভীতিকর এক পার্বত্য চট্টগ্রাম!
সময় এসেছে আপনাদের, নিজেদের বোধ হয় দৈনিক একবার আয়নার সামনে দাঁড়ানোর।

 

প্রদীপ চৌধুরীঃ পাহাড়ের সংবাদকর্মী

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 585 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen