শিরোনামঃ

পাহাড়ের ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষায় নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ‘চাঙমা একাডেমী’

আর্য্য মিত্র চাকমা, ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি (সম্মান)-এ ভর্তি হন। ‘৮৬ সালে বেড়াতে আসেন নিজবাড়ী দীঘিনালার বোয়ালখালীতে। কিন্তু সর্বনাশা Chakma MLE-সাম্প্রদায়িকতায় পরিবার-পরিজন-আত্মীয়দের নিয়ে ভারতে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরা হয়নি আর। ফিরে এসে দেখেন, সহায়-সম্বল পুড়ে ছারখার হয়েছে। বেদখল হয়েছে ভিটেমাটি-গাছপালাও।
নব্বই দশকে থিতু হন, খাগড়াছড়ি জেলাসদরের খবংপর্য্যা এলাকায়। পঠন-পাঠন আর লেখালেখির অভ্যেস সেই স্কুল জীবন থেকেই।
বিগত কয়েক দশক ধরেই শিক্ষকতা করছেন, বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
অর্ন্তগত স্বপ্ন ও চিন্তা থেকে চাকমা ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষায় নিবেদিত হবার প্রত্যয়ে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
তাঁর আহ্বানে ‘চাঙমা ভাষা ও সংস্কৃতি কমিটি’র ব্যানারে একটি সভা ডাকা হয়।
সূর্য্যশিখা ক্লাবে অনুষ্ঠিত সে সভায় সভাপতিত্ব করেন, চাকমাদের মধ্যে দ্বিতীয়তম আধুনিক কবি মুকুন্দ চাকমা। তিনি চাকমা ভাষাভাষীদের মধ্যে পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি।
আলো’র মুখ দেখে ‘চাঙমা একাডেমী। এর আগে যেকোন ধরনের সংগঠনকেই আঞ্চলিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। অস্থায়ী ঠিকানা হয়, মহাজন পাড়াস্থ সূর্য্যশিখা ক্লাবের একটি কক্ষে।
একে একে খাগড়াছড়ির চাকমা ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেমী প্রভাকর চাকমা, মধুমঙ্গল চাকমা, সুসময় চাকমা এবং সন্তোষিত চাকমা বকুলসহ নবীন-প্রবীন অনেকেই।
‘চাঙমা একাডেমী’ বিগত আধা যুগেরও বেশী সময় ধরে সীমিত সামর্থ্যে অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা করেছে। অন্তত কয়েক’শ নারী-পুরুষকে চাকমা বর্ণমালার প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে।
প্রকাশ করেছে ‘এজো চাঙমা সিঘি’ নামক একটি বর্ণমালা শেখার সমৃদ্ধ বই। আর্য্য মিত্র নিজে রচনা করেছেন, ‘চাকমা শব্দভান্ডাল’র নামে চাকমা ভাষার শব্দ সংকলন ও অভিধান।
আর্য্য মিত্র চাকমা বলেন, প্রথম প্রথম তরুণদের অংশ্রগ্রহণ কম থাকলেও এখন তা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। বোদ্ধা মহলের মতে, চাকমা বর্ণমালায় শিক্ষার ইতিহাসটা বেশ প্রাচীন। ১৮৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চন্দ্রঘোনা বোর্ডিং স্কুল’-এ চাকমা ও মারমাদের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা ও উপকরণ দিয়ে পৃথক পাঠদান করা হতো।
তৎকালীন হেড কোর্য়াটার চন্দ্রঘোনায় বোর্ডিং স্কুলটি পরবর্তীতে রাঙ্গামাটি সরকারী হাইস্কুলে পরিণত হয়। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত মারমা ভাষায় পাঠদান অব্যাহত থাকলেও চাকমা ভাষার পাঠদান নানা বাস্তবতায় বন্ধ হয়ে যায়।
চাকমা কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কাপ্তাইয়ের নারানগিরিতে জন্ম নেয়া শিপচরণের স্তুতিমুলক কবিতা গোজেনলামা (১৭৭৭), চিত্রশিল্পী ও কবি চুনীলাল দেওয়ান (১৯৪৪), আশির দশকের দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, ‘বার্গী’র কবি সুহৃদ চাকমা মুলধারার সাহিত্য অঙ্গনেও সুপরিচিত।
১৯৩৬ সালে বর্তমান চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের নানী এবং তৎকালীন রানী বিনীতা রায়ের সম্পাদনায় সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘গৈরিকা’ উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সংকলন হিসেবে চিহ্নিত। যদিওবা সে সংকলনটি পুরোটাই বাংলা ভাষায় রচিত ছিলো।
আর্য্য মিত্র চাকমা বলেন, অভিজাত সমাজের চোখে চাকমা ভাষার চেয়ে বাংলা ও ইংরেজীর প্রতি বেশী মনোযোগ ছিলো। অধিকন্তু চাকমা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি চাকমা রাজন্যবর্গের অনাদর-অনাগ্রহ পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত পরিলিক্ষিত হয়েছে। উনিশ শতকের আগে রচিত ‘চান্দবীর বারোমাস’ যেটি চাকমা হরফে বাংলাভাষায় লিখিত হয়েছিলো।
কিন্তু ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় চাকমাদের।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে চাকমা শিক্ষিত ও তরুণ সমাজকে বেশ আলোড়িত করেছে। ফলে নিজ ভাষায় কবিতা-গান ও সাহিত্যের নানা শাখায় অংশগ্রহন বাড়তে থাকে খুবই দ্রুত।
আর্য্য মিত্র স্বপ্ন দেখেন, ‘চাঙমা একাডেমী’ একসময় ‘বাংলা একাডেমী’র একটি ছোট্ট সংস্করণে পরিণত হবে। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা-প্রণোদনা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে চাকমা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ গড়ে উঠলেও বেশীদূর এগোতে পারেনা।
পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ন স্থানীয় সরকার কাঠামো ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটগুলো প্রয়োজনীয় এবং দক্ষ লোকবলের অভাবে প্রত্যাশিত মাত্রায় কাজ করতে পারছে না।
তবে ‘চাঙমা একাডেমী’র এই প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন, প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলা আগেই যদি সরকার পাহাড়ের মাতৃভাষা নিয়ে কিছু একটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় তাতে খুব ভালো ফল বয়ে আনবে না। কারণ, রাষ্ট্র ও সরকারকে নীতিগতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সাংস্কৃতিক সম্পদকে আপন ভাবতে হবে। ভাবনায় রাখতে হবে, দারিদ্র্যপীড়িত ও রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত জাতি গোষ্ঠিগুলোর বিদ্যমান জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক খাদকেও।
তিনি মনে করেন, প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি উন্নয়নে কেন্দ্র ও রাজ্যের সমন্বয়ে অনেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সুরক্ষার স্বার্থে এখানেও সেরকম কিছু করা সম্ভব।
মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, শিশুদের জন্য গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য মাতৃভাষার ভিত্তি খুবই জরুরী। যেটি সরকারের প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি, পিইডিপি-১.২ও ৩, পার্বত্যচুক্তি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনেও স্বীকৃত।

লেখক: প্রদীপ চৌধুরী, সংবাদকর্মী, খাগড়াছড়ি।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 471 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen