শিরোনামঃ

পার্বত্য চুক্তির বর্ষপুর্তিকে সামনে রেখে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে অসহযোগ আন্দোলনের পথে পা বাড়াবে জনসংহতি সমিতি : সন্তু লারমা

সিএইচটি টুডে ডট কম ডেস্ক। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা বলেছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল ২০১৫-এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম 4_nচুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগ্রতি না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের পথে পা বাড়াবে। সরকারকে চুক্তি বিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধের দাবী জানান তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এই সময়সীমা বেঁধে দেন। আজন ২৯ নভেম্বর শনিবার রাজধানী ঢাকাস্থ হোটেল সুন্দরবন-এ এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এমপি, আইইডি নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান, মানবাধিকার কর্মী এ্যাড. নীলুফার বানু, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। এইছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজীব মীর, চলচ্চিত্রকার রাশেদ রাইন, আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক বিনোতাময় ধামাই প্রমুখ ব্যক্তিগণ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সন্তু লারমা বলেন, জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধ করারএবং চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে বিদ্যমান পরিস্থিতি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ বা অশান্তিপূর্ণভাবে ১ মে থেকে অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচী পালন করা হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকারের অবস্থান বিষয়ক অপর এক প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছে ত অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও মনগড়া। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সর্বশেষ কখন অনুষ্ঠিত হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে সন্তু লারমা বলেন, সর্বশেষ বৈঠকটি কবে হয়েছে তা তিনি স্মরণ করতে পারছেন না। তিনি বলেন এই হলো সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নের নমুনা।
সন্তু আরো লারমা বলেন, পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পার হতে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। আশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। এর মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী আধিবাসীরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করবে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের ১৭ বছরেও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার কাঙ্খিত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত হয়নি।
সন্তু লারমা অভিযোগ করে বলেন, বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক-বেসামরিক আমলা নির্বিচারে জায়গা দখল করছে। নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলায় ২১টি চাক পরিবারকে উচ্ছেদ করে প্রাক্তণ ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ জলাভূমি দখল করেছে। লামা উপজেলায় আনিসুর রহমান ও মোঃ মোহসিন বাদল (লাদেন গ্রুপ খ্যাত) ৭৫টি ম্রো, ত্রিপুরা মারমা ও স্থায়ী বাঙালি পরিবার উচ্ছেদ করে ১৭৫ একর জমি দখল করেছে। মুজিবুল হক গং মারমা গ্রামবাসীর উপর হামলা চালিয়ে প্রায় ৫০০ একর জায়গা দখল করেছে। রোয়াংছড়ি উপজেলায় মোঃ সামাদ আলী নামের বহিরাগত ৩৩টি মারমা পরিবারের রেকর্ডিয় সম্পত্তি জাল করে বন্দোবস্তকরণ ও জবরদখলের চেষ্টা করছে। আলিকদম উপজেলায় বদিউল আলম গং ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারের এক হাজার একর রেকর্ডিয় ও ভোগদখলীয় জমি জবরদখল করেছে।

সন্তু লারমা বলেন, প্রশাসনে ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপডিএফ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও সংস্কারপন্থি নামে খ্যাত বিপথগামী গোষ্ঠী অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাসহ সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এ পর্যন্ত ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থি সন্ত্রাসীরা ৯৩ জন সদস্যসহ ৩ শতাধিক খুন ও নিরীহ লোকজনকে অপহরণ-নির্যাতন করেছে। সম্প্রতি পাহাড়ে ও সমতলে ১৬ জন আদিবাসী নারী যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকার কেবল চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বছরের পর বছর ধরে অবাস্তবায়িত রেখে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য, বিভ্রান্ত্রিমূলক ও মনগড়া তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি পরিপন্থি ও জুম্মস্বার্থ বিরোধী আইন প্রণয়ন এবং কার্যক্রম হাতে নিয়ে চলেছে। চুক্তির অবাস্তবায়িত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিয়ে সরকার উল্টো চুক্তি লংঘন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে আইন প্রণয়নের বিধান রয়েছে। সেই বিধি-বিধানকে পদদলিত করে একতরফাভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন তৈরি এবং রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
সন্তু লারমা সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে সরকার। সরকারের আলামত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়নে আর কার্যকর পদক্ষেপ নেবে না। চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম হাতে নেবে। যার মূল উদ্দেশ্যই হলো আদিবাসী জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা।

সংবাদ সম্মেলনে আই.ই.ডি.-এরনির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আশা করেছিলাম বাংলাদেশ বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু ধর্মের একটি রাষ্ট্র হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে রাষ্ট্র এক ভাষা, এক জাতি ও এক ধর্মের হয়েছে এবং আদিবাসীদের সঙ্গে রাষ্ট্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মানবাধিকারকর্মী এ্যাড. নীলুফার বানু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য শান্তি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সরকার তার দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালিত করছেনা। চুক্তি সম্পাদনের পর যে পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়ন করবে অসহযোগিতা করবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় রয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, অন্যতম জাতীয় নেতা সন্তু লারমা যে আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়েছেন এই কর্মসূচীর সাথে ভিন্নমত থাকার কোন প্রশ্নই নেই। তিনি বলেন দেশের আপমার জনগণ জনসংহতি সমিতির এই অসহযোগ আন্দোলনের সাথে একাত্ম প্রকাশ করে এই আন্দোলনে শরীক থাকবে। এই কর্মসূচী দূর্বিসহ জীবন, সংগ্রাম ও বঞ্চনার প্রতিদিনকার নির্যাতনেরই প্রতিফলন বলে তিনি উল্লেখ করেন। কায়েমী স্বার্থবাদী আমলা চক্র, সামরিকতন্ত্র এবং উগ্র মৌলবাদী শক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রতিটি ধারা-উপধারাকে বাধাগ্রস্থ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। পংকজ ভট্টচার্য বলেন সরকারের একটি অংশের মধ্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারা কাজ করছে। এই সকল পাকিস্তানপন্থী চক্রের চিন্তাধারায় সরকার অনেকাংশে জিম্মি। যার ফলে সরকার আদিবাসীদের শুধু প্রতিশ্রুতি দেয়, চুক্তি করে, কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন করে না।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 706 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen