শিরোনামঃ

নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তৃতীয়

ফজলুর রহমান রাজন, রাঙামাটি। ভারত মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। এককালে অধিক তুলা উৎপাদন হত বলে বৃহত্তর এই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিচিতি ছিল কার্পাস মহল নামে। ১৮৬০ সালে সর্ব প্রথম পৃথক জেলায় রূপান্তরিত হয় এটি। অতঃপর ১৯৮৩ সালে বান্দরবান এবং পরে খাগড়াছড়িকে জেলায় উন্নীত করে রাঙামাটিসহ তিনটি জেলায় বিভক্ত করা হয় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামকে। পাহাড়ি অঞ্চল এই পার্বত্য জেলা সমূহে বসবাসরত আদিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস অতি সুপ্রাচিনকালের। ইতিহাসের মূল উপাত্ত খুঁজে পাওয়া না গেলেও খ্রিষ্টিয় ৫ম শতাব্দীর দিক থেকে আদিবাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।P1130470 সেই আদিকাল থেকে যুগ যুগ ধরে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে আসছে ১০ ভাষাভাষি ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠি। বৈচিত্র এই জনগোষ্ঠি সমূহের জীবন ও সংস্কৃতি যেমন চিরাচরিত ঐতিহ্যে লালিত তেমনি বর্ণিল ও নান্দনিক। তাদের বর্ণিল সামাজিক ও সংস্কৃতি জীবন ধারা খুবই সুন্দর ও দর্শনীয়। এ সমস্ত সামাজিক ও সংস্কৃতির জীবন ধারা জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটি সূত্রে চির গাথা।
এ অঞ্চলে বসবাসরত ১০ ভাষাভাষি ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠি হল চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা টিপরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, চাক, খুমী, পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং। প্রত্যেকটি জাতিরই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে। সংখ্যা গরিষ্ঠতার দিক দিয়ে ক্রমানুসারে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাই প্রধান। আজ দেখুন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জীবনধারা
ত্রিপুরা বা টিপরা জনগোষ্ঠি
‘তোয় প্রা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে টিপরা বা ত্রিপুরা জাতি গোষ্ঠির নাম করন। তোয় অর্থ নদী বা জল। আর ‘প্রা’ অর্থ নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। অর্থাৎ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে যারা বসবাস করত তাদেরকে বলা হতো ‘তোয় প্রা’। এই ‘তোয় প্রা’ শব্দটি কালক্রমে টিপরায় পরিবর্তিত হয়েছে। ত্রিপুরাদের লোকমুখে প্রচলিত উপকথা থেকে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলার চেঙ্গি নদকে বলা হতো সিয়াই তোয় কুতুং। এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায় সিয়াই চেঙ্গি নদ, তোয় জল আর কুতুং অর্থ পাগলা। অর্থাৎ পাগলা জলের সিয়াই বা চেঙ্গি নদ। তাহলে ওই উপকথা মতে জানা যাক চেঙ্গি কেন পাগলা নদ হয়ে আছে।
চেঙ্গি নদ বা সিয়াইয়ের মায়ের নাম কাঁইচা। এই কাঁইচা ছিলেন পাহাড়ি রাজকন্যা। তবে চিল একটি মাত্র ছেলে। ছেলের নাম সিয়াই। সিয়াই ছেলেবেলা থেকেই উদাসীন এবং অবোধ। মায়ের অবাধ্য। সে শুধু বনে বনে ঘুরে বেড়াত। দিন দিন বয়স বাড়লেও বুদ্ধি বাড়লনা সিয়াইয়ের। আর ভালো হওয়ার কোন লক্ষনও দেখা দিলনা। সে হলো শুধু বখাটে আর ভবঘুরে। মা কাঁইচা প্রমাদ গুনলেন ছেলেকে মানুষ করার জন্য হাজারো চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন মতেই মানুষ করতে পারলেননা। মায়ের কোন কথাই গ্রাহ্য করলনা সিয়াই।P1130452
একদিন ভীষন রেগে মা সিয়াইকে অকথ্য গালমন্দ করলেন। সিয়াই এতে মার সাথে রাগÑধাক করে দেশ ত্যাগ করল। এভাবে বনে জঙ্গলে ঘুরে অনেকদিন কাটল তার। অবশেষে সে নোয়াখালি জেলার সীমান্ত অঞ্চলের এক গহীন অরণ্যে এসে হাজির হলো সে। সেখানে দেখা হলো অপূর্ব সুন্দরী এক রাজকন্যার সাথে। তার নাম তোয়মা। তোয়মা শুধু রুপে নয় গুণেও অতুলনীয়। তার রুপে গহীন জঙ্গল আলোকিত হয়ে থাকত। তোয়মার রুপে মুগ্ধ হল সিয়াই। এক পর্যায়ে দু’জনের মধ্যে জন্ম নিল ভালোবাসার। সিয়াই মনস্থির করল তোয়মাকে বিয়ে করবে। তাই একদিন এক অন্তরঙ্গ মুহুর্তে সিয়াই তোয়মাকে বুকে জড়িয়ে বলল, তোয়মা, তোয়মাথ আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।’
কিন্তু তোয়মা বলতেই রাজকন্যা ছিটকে সরে গেল দশ হাত দূরে। ভীষণ রাগ হল সিয়াইয়ের ওপর। কী প্রয়োজন ছিল তার এভাবে সম্বোধন করে ডাকার ? তার কারণ, ত্রিপুরা ভাষায় তোয়মা অর্থ জল মা। আর এই জল মা ই হলেন মা গঙ্গা। তাহলে মায়ের সঙ্গে বিয়ে করা কি সম্ভব ?
ত্রিপুরাদের মধ্যে মেয়েদের নাম ধরে সম্ভোধন করতে নেই। বিশেষ করে স্বামীদের পক্ষে খুবই অগ্রগণ্য। তোয়মার প্রেমের আঘাতে ভীষণ দুঃখ পেল সিয়াই। এত নিজের জীবনকে নিরর্থক মনে হল তার। এভাবে দুঃখ আর যন্ত্রণা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে এলো সে। এদিকে পুত্র শোকে ইত্যবসরে মা কাঁইচাও মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তিনি হয়ে আছেন কর্ণফুলী নদী। এই অবস্থায় সিয়াই আর কি করবে ? সে এখন বুঝতে পেরেছে সারা জীবন মায়ের আদেশ অমান্য করায় আজ তার এমন পরিণতি ঘটেছে। কেননা, মায়ের অভিশাপ কী কখনো মোচন করা যায় ? এ দুঃখ আর যন্ত্রণায় কেঁদে কেঁদে সে অনন্তকাল ধরে অপরের উপকারের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে চেঙ্গি নদ হয়ে গেল। আর সেই তোয়মাই বর্তমান ফেনী নদী। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির মতে সিয়াইয়ের এখনো রাগী স্বভাব কাটেনি। সে এখনও মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাই চেঙ্গি নদের দুই ক’ল প্লাবিত হয়ে বন্যা নামে। এজন্যই ত্রিপুরা ভাষায় চেঙ্গি নদকে সিয়াই তোয় কুতুং বলা হয়।
বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার সর্বত্রই বিচ্ছিন্নভাবে ত্রিপুরা আদিবাসীদের বসবাস রয়েছে। তবে খাগড়াছড়ির রামগড়েই অধিক সংখ্যক হারে তাদের বসবাস রয়েছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠিরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, কেউ কেউ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করেন। তবে তারা ধর্মে হিন্দু হলেও তাদের সম্পূর্ণ আলাদাভাবে নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সমাজ ও সংস্কৃতি রয়েছে। ভারতবর্ষে তাদের ভাষাকে বলা হয় কক্ব রক। ভারতীয় উপমহাদেশে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠি অত্যন্ত প্রাচিনতম জাতি। নৃতাত্ত্বিকদের বিচারে ত্রিপুরারাও মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। ইতিহাসবিদদের মতে, এই জনগোষ্ঠির পূর্ব পুরুষরা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে মধ্য এশিয়ার তিব্বত ও সাইবেরিয়া হয়ে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিল। অতীতে উপমহাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ন ভূমি তে ভাগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত মিলে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৯ লক্ষ বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, ফরিদপুর ও বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে এদের বসবাস রয়েছে। রাজবংশী, বর্মন, গাঁরো, হাজং ও মনিপুরিরাও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে এদের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। পার্বত্য তিন জেলায় ত্রিপুরাদের বর্তমান জনসংখ্যা লক্ষাধিক। ১৯৯১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী তা ছিল ৬২ হাজার। DSC07060
ত্রিপুরারা অনার্য। এদের গড়ন মাঝারি ধরনের। গায়ের রং উজ্জ্বল, নাক বোঁচা, টানা টানা চোখ ও খাড়া চুলের অধিকারি। ত্রিপুরারা মোট ৩৬টি গোত্রে বিভক্ত। প্রত্যেকটি গোত্রের পৃথক পৃতক কথ্যরীতি, পোষাক পরিচ্ছদ, অলংকার ও আচার অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়। সামাজিক ক্ষেত্রে ত্রিপুরা জাতি পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান কর্তা। পিতার অবর্তমানে তার জৈষ্ঠ পুত্র কর্তা হিসেবে বিবেচিত হন। পরিবারের পুত্র সন্তানেরা পিতার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পর সমস্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ভোগ দখলের উত্তরাধিকারি হয়। ত্রিপুরা সমাজে সর্ব গোত্রের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সিদ্ধ। রক্ত সম্পর্কীয় তিন পুরুষের মধ্যে তাদের বিবাহ বন্ধন নিষিব্ধ।ত্রিপুরারা সনাতন ধর্মের লোক হলেও বৈদিক বর্ণিত সকল দেব দেবির ত্রিপুরা সমাজে পূজা হয়না। এ সমাজে মাত্র ১৪ জন দেব দেবির উদ্দেশ্যে পূজা পার্বন হয়। ত্রিপুরারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে এবং তান্ত্রিকাচারে দর্মীয় পূজা পার্বন সম্পাদন করে থাকেন। যিনি পূজা করেন তাঁকে চোন্ডাই বা অচাই নামে অভিহিত করা হয়। ত্রিপুরাগণ শৈব বা শিবের পূজারী। শিব বা মহাদেবের স্ত্রী, সন্তানথ সন্ততি, অনুচর অনুচারীদের পূজা করে তারা। হিন্দু দেব দেবীদের নামের সাথে ত্রিপুরাদের দেব দেবীদের নামের সামঞ্জস্যের কারণে ত্রিপুরারা হিন্দু ধর্ম দ্বারা প্রবাবিত হয়। ত্রিপুরারা অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে লক্ষীপূজা করে থাকে।
ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হল বুইসুক বা বৈসুক বা বিষু। উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরাব্দ প্রবর্তিত হয়েছিল বিষু সংক্রান্তিতে। বাংলা বর্ষের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনে এই বৈসুক পালন করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দু’দিনের প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বুইসুক। দ্বিতীয় দিনকে বলা হয় বুইসুকমা এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে বলা হয় বিসিকাতাল। এ সময় ফুল দিয়ে ঘর সাজানো, নতুন কাপড় পরিধান, খাবার দাবার ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন, গরাইয়া নৃত্য পরিবেশন ও পূজা অর্চনার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
ত্রিপুরারা সন্তান জন্মের পর এবং নামকরণের জন্য নানা আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তাদের পরিবারে কারো মৃত্যু ঘটলে একটি বিশেষ তালে ঢোল বাজানো হয়। এ শব্দ শুনে লোকজন বুঝতে পারে কারো মৃত্যৃ হয়েছে। মৃতদেহের পায়ের কাছে একটি মোরগের বাচ্চা জবাই করা হয়। তারপর মৃতদেহটি বান করিয়ে ভাঁশের তৈরি শবাধারে করে শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হয়। বিবাহের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ পিতা মাতা ও অভিভাবকরা পাত্র পাত্রী নির্বাচন করেন। বর পক্ষই কনে পক্ষকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কনে পক্ষ পনের টাকার বিভিন্ন্ পোষাক পরিচ্ছেদ ও অলংকার দাবি করতে পারেন। নির্দিষ্ট দিনে পূজা অর্চনা সেরে বর পক্ষ কনে বাড়িতে যায়। ত্রিপুরারা নৃত্য, গীত ও বাদনে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাদের জীবন জীবিকা, আচার আচারনে গীতি নৃত্য ও বাদন অবিচ্ছেদ্য। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আচার, পূজা পার্বনেও নাচ, গান ওবাদন অতি অবশ্য কর্তব্য।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ত্রিপুরাদের সংখ্যাগরিষ্ট অংশের জীবিকার উৎস হল জুম চাষ, পশু পালন ও হাল চাষের মাধ্যমে জমি চাষাবাদ। বর্তমানে ত্রিপুরাদের বহু শিক্ষিত লোক চাকরি ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত। জুম ও কৃষি কাজের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির মধ্যে দারিদ্রের হার বেশি।

আগামী শনিবার দেখুন তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠির জীবনধারা

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 1,941 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen