শিরোনামঃ

মাতৃভাষায় পাঠদান ব্যাহত হওয়ার আশংকা

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সমন্বয়হীনতার কারনে চলতি বছর পাঠ্য বই পাচ্ছে না আদিবাসী শিশুরা

সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সমন্বয়হীনতার কারনে চলতি বছর পাঠ্য বই পাচ্ছে না ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীরা শিশুরা। বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে শিক্ষানীতি ২০১০ প্রনয়ন করে। শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১২ সনে শিশুনীতি Tribel sishu rgtপ্রনয়ন করে। তারই আলোকে এবং পার্বত্য পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য ৫টি বর্নমালায় বই প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল চলতি বছর (২০১৫ সন)। ব্রিজিং পদ্ধতি নাকি বর্ণমালায় পাঠদান হবে এসব সিদ্ধান্তহীনতার পাশাপাশি প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে এ বছরও মাতৃভাষায় তথায় বর্ণমালায় পাঠ্য বই পাচ্ছে না শিশুরা এমনটা জানালেন এর সাথে জড়িতরা।

মাতৃভাষা শিক্ষা লাভ করা প্রত্যেক জাতির মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র ভাষার পর পরই স্ব স্ব মাতৃভাষায় পাঠদানের বিষয়টি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীগুলোর ভাষা শিল্প ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের একজন যুগ্ন সচিবের নেতৃত্বে ২০১২ সনে মাল্টি ল্যাংগুয়েজ এডুকেশন (এমএলএ) নামে ২০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে পাহাড় এবং সমতল থেকে শিক্ষাবিদ রাখা হয়। কমিটি আলোচনা পর্যালোচনা করে ২০১৪ সালে প্রাক প্রাথমিক স্তরে ৫টি ভাষায় ( পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ৩টি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং সমতলে সাদরি ও গারো) বই প্রকাশনা এবং ২০১৫ সন থেকে পাঠ্য বই হিসেবে শিশুদের হাতে দেয়ার কথা থাকলেও এমএলএ কমিটির সাথে সরকারের মন্ত্রনালয়, জাতীয় শিক্ষা পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের সাথে জড়িতদের সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে ৫টি ভাষার বর্নমালার বই শিশুরা ২০১৫ সনে পায়নি। তবে বর্ণমালায় নাকি ব্রিজিং ( নিজস্ব বর্ণমালা না থাকলে অন্য ভাষার সাথে সেটি সমন্বয় করা) পদ্ধতিতে শিশুরা পাঠদান করবে এটি নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে সবগুলো জাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা নেই, কয়েকটি জাতি গোষ্ঠীর বর্ণমালা আছে আবার কোন কোন সম্প্রদায় রোমান হরফে নিজস্ব মাতৃভাষা শিখছে তাই কোন কোন সম্প্রদায়ের বর্ণমালায় আবার কোন সম্প্রদায় রোমান বর্নে নিজস্ব মাতৃভাষায় শিখবে এটি নিয়ে এমএলএ কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
বর্তমান কোন কোন স্কুলে ছবি দেখিয়ে নিজস্ব বর্ণমালায় শিশুদের পাঠদান করা হচ্ছে যা শুধু বোঝার জন্য। কিন্তু বর্ণমালায় লিখা শেখানো হচ্ছে না। এর কারন হিসেবে অনেকেই বলছেন আগে স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার জন্য শিক্ষক তৈরি করতে হবে। যদি শিক্ষক নিজেই মাতৃভাষার বর্ণমালা না জানেন তাহলে শিশুদের পড়াবে কে?
অনেকের মতে ঢাকায় বসে বর্নমালা ঠিক করলে হবে না এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে বসে সমন্বয় করে মতেবর্নমালায় বই তৈরি করতে হবে নতুবা শিশুরা ভুল শিখতে পারে।
এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাছে হস্তান্তরিত অথচ পাঠ্যপুস্তক প্রনয়ন বিষয়ক কমিটিতে তাদের কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি, এমনকি তাদের ডাকাও হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটের পরিচালক জানালেন রনেল দেওয়ান জানান, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের স্কিপ বা বর্ণমালা ছাড়া আমাদের অন্য কোন বর্ণমালা নেই, আমরা মৌখিকভাবে দৈনন্দিন কাজ কাজ করতে পারলেও পাঠ্য পুস্তক প্রনয়ন করতে হলে আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে না হলে শিশুরা ভুল শিখবে। জেলা পরিষদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউট শিক্ষকদের বর্ণমালা প্রশিক্ষনের আয়োজন করলেও এটি ছিল সীমিত। পাঠ্য পুস্তকে আমাদের স্ব স্ব ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যথাযথভাবে তোলে ধরতে হলে সব সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এমএলএ কমিটির সদস্য আদিবাসী শিক্ষাবিদ ও লেখক মৃত্তিকা চাকমা বলেছেন, আমাদের বর্ণমালা আমাদের মত করে হতে হবে গনশিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে চাপিয়ে দিলে হবে না। এখন বিভিন্ন এনজিও তাদের মত করে কাজ করছে কেউ সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমি গতবার সভায় প্রস্তাব দিয়েছি রাঙামাটিতে একটা সভা করার জন্য কারন এলাকায় বসে বর্ণমালার কাজ করলে ভুল ত্রুটি মানুষের পরামর্শগুলো থেকে আমরা একটা সমাধানে যেতে পারব। আমার মতে স্ব স্ব ভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক ভাষাটা গড়ে উঠুক। প্রথম ভাষা স্ব স্ব ভাষা , সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ বাংলা পরে ইংরেজী এভাবে করে ক্রমান্বয়ে শিশুরা গড়ে উঠবে।
তিনি আরো বলেন, এবছর ৬টি বই বের হওয়ার কথা থাকলেও সমন্বয়হীনতা আর সাওতালদের বর্ণমালার সমস্যার কারনে সেটি বাদ দিয়ে ৫টি বের হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কেন বের হয়নি জানি না।
জাবারাং এর নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, এমএলএ কমিটির সভায় ৫টা ভাষার বর্ণমালা বই প্রকাশিত হওয়ার কথা গত বছর, এবছর শিক্ষার্থীদের হাতে বইগুলো পৌছানোর কথা থাকলেও কেন হয়নি জানি না।
তিনি আরো বলেন, আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সমন্বয়হীনতা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে রদবদলের কারনে অনেক সময় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। তার মতে আদিবাসীদের জন্য একটি ভাষা ইনষ্টিটিউট থাকার দরকার তাহলে কাজগুলো করতে আরো সুবিধা হতো।
বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মানবধিকার কর্মী নিরুপা দেওয়ান বলেন, ২০১০ সালে শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা চালুর কথা সেটির বিষয়ে ধীরগতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সমন্বয়হীনতা আমাদের হতাশ করে দেয়। সরকারের অনেক বিষয়ে অনেক সময় আন্তরিকতা থাকলেও সরকারের ভিতরে থাকা এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এর বাধা হয়ে দাড়ায়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর মধ্যে রাঙামাটি জেলা পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা জানান, পার্বত্য জেলা পরিষদ নিজস্ব উদ্যোগে চাকমা, মারমা এবং তংচঙ্গ্যা বর্ণমালায় ৩টি বই বের করেছে। তবে কোন বই কারিকুলামে অর্ন্তভুক্ত করতে হলে সেটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড করে। এখানে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষা চালুর আগে স্ব স্ব জাতি গোষ্ঠীর শিক্ষক তৈরির উপর জোর দেন তিনি। কারন শিক্ষক যদি বর্ণমালা না জানেন তাহলে তিনি শিশুদের পড়াবেন কিভাবে?
তবে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী যে এমএলএ কমিটি করেছে তাতে ৩ জেলা পরিষদকে অর্ন্তভুক্ত করেনি। যদি পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর প্রতিনিধিরা কমিটিতে থাকত তাহলে তারা জোরালো ভুমিকা নিতে পারত। রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আরো বলেন, কোন জেলা পরিষদ কোন ভাষার উপর কাজ করবে সেটির বিষয়ে শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় করে তাহলে কাজটি আরো দ্রুত হবে।
সরকারের স্ব স্ব জাতির সত্বার মাতৃভাষার উপর পাঠদানের জন্য গঠিত মাল্টি ল্যাংগুয়েজ এডুকেশন (এমএলএ) কমিটি যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতল এলাকায় সমন্বিত কাজ করে তাহলে পাহাড়ে শিক্ষার হার ঝড়ে যাওয়া রোধ হওয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য রক্ষা পাবে এমনটা মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল ।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 661 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen