বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারই ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে এবং এই সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্মর্তব্য যে, এরশাদের সামরিক সরকার ও খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত বিএনপি সরকারের সাথেও জনসংহতি সমিতির দীর্ঘ সংলাপ হয় এবং অনেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। যদিও এই দুই সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত আলোচনা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারেনি।
পার্বত্যবাসীর আশা ছিল, চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। সংঘাত-সংঘর্ষের পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই অঞ্চলের জাতিগত বিলুপ্তির দিকে ধাবমান জুম্ম জাতিসমূহ তাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা পাবে এবং ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। জাতিগত ও প্রকৃতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ এই অঞ্চলটি চুক্তির আলোকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল হবে এবং দেশের জন্য এক অনন্য ভাবমূর্তি সৃষ্টি করবে। এখানে আর সাম্প্রদায়িক পরিবেশ থাকবে না। সত্যিকার অর্থে এখানে উন্নয়নের যাত্রা শুরু হবে।
কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ ২০ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, এখনও পর্যন্ত চুক্তিটি, বিশেষ করে চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নে সরকারের কোন আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য সমস্যার অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যার একটি ভূমি বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি; একজন অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুও পুনর্বাসন করা হয়নি; দীর্ঘ ২০ বছরেও আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি ও নির্বাচিত পরিষদ গঠন করা যায়নি; সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেয়া এবং এই লক্ষে সময়-সীমা নির্ধারণ করার বিধান থাকলেও এখনো তিন শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প ও ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহার করা হয়নি; জেলা পরিষদে এখনও সকল বিষয় হস্তান্তর করা হয়নি, যেগুলো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেক বিষয় চুক্তি অনুযায়ী যথাযথভাবে হস্তান্তর ও কার্যকর করা হয়নি। বস্তুত, বলা যায় সরকার বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে।
শুধু তাই নয়, সরকার উল্টো চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত জুম্ম জনগণসহ স্থায়ী বাসিন্দাদের অধিকার খর্ব হচ্ছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, তেমনি অপরদিকে উন্নয়নের নামে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের ফলে জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে এ যাবৎ শত শত একর জুম্মদের জুমভূমি ও আবাসভূমি বেদখল করা হয়েছে, এখনও দখলের প্রক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে বান্দরবানের নীলগিরি (কাপ্রু ¤্রাে পাড়া), জীবন নগর (সেপ্রু পাড়া), চন্দ্র পাহাড়, ডিম পাহাড় (ক্রাউডং), নীলাচল ও রাঙ্গামাটির সাজেক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে মোট ২৬টি গ্রামের অন্তত ৬৯৭টি ¤্রাে, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার উচ্ছেদ ও ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগে ক্যাম্প সম্প্রসারণ, নতুন ক্যাম্প স্থাপনের নামে প্রতিনিয়ত জুম্মদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে বা বেদখলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে একপাশে সরিয়ে রেখে উন্নয়নের নামে জুম্মদের জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ ও বহিরাগত পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে জুম্মদের সংখ্যালঘু করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকার, সরকারের স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদী ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের যোগসাজসে একতরফাভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপন, রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল-ঠেগামুখ সংযোগ নির্মাণ, রাঙ্গামাটি জেলার কাচালং ও সীতাপাহাড় ভূ-গঠনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বস্তুত চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে, পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের নামে এধরনের একতরফা উদ্যোগ পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এবং পার্বত্যবাসীদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না।
জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখাশোনা করার কথা পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু দু:খজনক যে, সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে হিসেবে পার্বত্যাঞ্চলের জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা পালন করার কথা, সে হিসেবে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। বরঞ্চ প্রায় ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে ক্ষমতাসীন দলের পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদীরা। তারা মুখে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও কাজেকর্মে কার্যকর কোন ভূমিকা দেখা যায় না। তাই জনসংহতি সমিতি যখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে, বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দেয় এবং চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানায়, তখনি তারা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের চেয়ে অতিউৎসাহী হয়ে ‘চুক্তির অধিকাংশ বিষয় বা চুক্তির ৯৮% ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে’, ‘সব হবে, ধীরে ধীরে হবে, হচ্ছে’, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জনসংহতি সমিতি ও সন্তু লারমা মিথ্যাচার করছেন’ বলে প্রতারণা ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এমনি এমনি আসেনি, হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে সামরিক ও নির্বাচিত তিন-তিনটি সরকারের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে মোট ২৬ বার বৈঠক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তবেই বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। আর এই চুক্তির ফলে দীর্ঘ দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও জনসংহতি সমিতির মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হয়েছে এবং জনসংহতি সমিতি সরকারের নিকট অস্ত্র জমা দিয়ে জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসন আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে প্রত্যাবর্তন করে। পাহাড়ি-বাঙালি বহু মানুষের জীবন, জনসংহতি সমিতির অনেক সদস্যের বহু রক্তপাত, অসংখ্য জুম্ম মা-বোনের ইজ্জত, অগণিত জুম্ম নর-নারীর বহুমুখী ও ব্যাপক ভিত্তিক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে এই চুক্তি অর্জিত হয়েছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প থাকতে পারে না।
যে লক্ষ্য ও আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, চুক্তিটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সে লক্ষ্য আজ ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে এবং আশা-আকাক্সক্ষা ধুলিসাৎ হতে চলেছে। বিশেষ করে চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর ভূমিকার অনুপস্থিতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ বঞ্চিত ও নিপীড়নের শিকার আদিবাসী জুম্ম ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর যাই হোক শান্তি, সংহতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। সমস্যাটি সমাধানের বিপরীতে বরং অধিকতর জটিল আকারই ধারণ করবে। ফলে সামগ্রিক স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন জরুরী।
লেখক: সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি