সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯তম বর্ষপুর্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সদস্য ও চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেছেন, শান্তি চুক্তির অনেক কিছু বাস্তবায়িত হলেও মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিগত বছর থেকে আমরা যদি এ বছর পর্যন্ত যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে পার্বত্য চুক্তির স্বপক্ষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। একটি হচ্ছে ২০০৯ সালের পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধন যা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে হয়েছে। এটি একটি ভাল উন্নয়ন বলা যায়। অপরটি হলো হিল ট্যাক্টস ম্যানুয়েল ১৯শ সনের বৈধতা দেয়া। আমরা এর মধ্যে ভূমি কমিশনের ২টি বৈঠক করেছি। এর মধ্যে দরখাস্ত এসেছে, কিন্তু কিভাবে বিচার কার্যক্রম করা যায় এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, কমিশনের যে জনবল, যে কারিগরি, আর্থিক যে অবস্থা সেখানে যথাযথ সহযোগিতা সকলের কাছ থেকে লাগবে। এটির একটি বিধিমালা প্রনয়ন করতে হবে বলে আমরা মনে করি। কিভাবে আইনটি কার্যকর হবে। সমস্যার সমাধান হবে। দ্বিতীয়ত হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের রেগুলেশন এর বৈধতা বা তার মর্যাদা। এটা অনেক বছর আগে হাইকোর্ট বিভাগে একটি মামলায় ছিল। সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি মৃত আইন। এই রেগুলেশনের বৈধতা বা কার্যকারিতা নেই। সেটার বিরুদ্ধে যেমন সরকার, আঞ্চলিক পরিষদ আপিল করেছে। প্রায় এক মাস হয়েছে যে, মহামান্য আপিল বিভাগ ঘোষণা করেছেন যে, হাইকোর্ট রায়টি সেই রায়টি বেআইনি। অর্থাৎ রেগুলেশন একটি পূর্ণাঙ্গ বলবৎ এবং বৈধ আইন। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রেগুলেশনের বিষয় কম যুক্তি উল্লেখ থাকলেও এটার কিন্তু প্রত্যক্ষ গুরুত্ব অনেক। আমাদের যে এখানে সনাতন প্রতিষ্ঠান রয়েছে চীফ হেডম্যান কারবারি তাদের ভূমিকা এবং এখানে যে স্থানীয় প্রথা রীতি নীতি রয়েছে, সেগুলোর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ আমরা স্বীকৃতি পেয়ে থাকি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটা সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন এ আইনটি থাকা মানে হলো যে আদিবাসীদের ভূমি ও অন্যন্যা প্রথাগত অধিকার থাকা। আমরা মনে করি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৯তম বর্ষপুর্তি উপলক্ষে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় একান্ত আলাপচারিতায় সিএইচটি টুডে ডট কমকে এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বিগত বছরের তুলনায় মোটা দাগে এই দুটি দিক ভালো হয়েছে। এখানে চুক্তি অনুসারে আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ, পার্বত্য জেলা পরিষদের যে ভূমিকা থাকার কথা সেই ভূমিকা আমরা এখনো দেখছি না। সীমান্তে বিজিবি’র মাধ্যমে অনেক কিছু চাউনি ও বিওপি স্থাপিত হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে যেখানে সীমান্ত রয়েছে সেখানে বিজিবি থাকবে যে কোন অঞ্চলের ন্যায় এবং চুক্তির মধ্যে কোন সমস্যা নাই কিন্তু ইদানিং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে বিজিবি’র ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা আশা করবো যে সরকারের কাছে চুক্তিকে ফলো করে সেভাবে যাতে সবকিছু হয়। এক সময় জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখার তৎপরতা ছিল এটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে যে সমস্যা ছিল সেটা এখন আর নেই। এখানে যদি সমস্যা থাকেও তবে অনেকাংশে কমে এসেছে। তবে এখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে রক্ষা করাটা সেটা যথাযথ না।
শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চুক্তিকে যদি আমরা ভোজের সাথে তুলনা করি তাহলে বলা যায় এখানে যে প্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে প্লেটগুলো সাজানো হয়েছে, গ্লাসগুলো সাজানো হয়েছে, জগগুলো সাজানো হয়েছে এখন যদি আমরা তরকারির দিকে দেখি, এখানে দেখবো যে যতগুলো তরকারি ওখানে থাকার কথা মাছ, মাংস, ডিম এর মধ্য থেকে মূল মূল কিছু জিনিস নেই। গুনলে সরকার মাঝে মাঝে বলেন এত শতাংশ । আমি তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছি এখন যদি আমি মাংসকে বেশি দরকারি মনে করি বা আমরা এ অঞ্চলে নাপ্পি খাই, শুটকি খাই, সেই ভোজের মধ্য যদি শুটকি, নাপ্পিটা বা মাংসটা না থাকে আপনি অনেক ধরনের সবজি দিয়েছেন কিন্তু মুল তরকারিটি দেননি তাহলে সে খাবার কি পরিপুর্ন হবে? কাজেই সেই আঙ্গিকে আমি যদি বলি, যে প্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে ভূমি কমিশন, জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ সেগুলো প্লেট গ্লাস, জগ ঠিক ঠিক জায়গায় আছে। কিন্তু প্লেটগুলো ভিতরে কি আছে সেটি জানলে আমরা সার্বিকভাবে চুক্তির অবস্থাটা বুঝতে পারি।
চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় আরো বলেন, পাহাড়ের আভ্যন্তরীন শরর্ণার্থী রয়েছে তাদের পুর্নবাসনে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি বিগত কয়েক বছরে। যারা শরর্ণার্থী আগে পুর্নবাসিত হয়েছেন অনেকে পুর্নবাসিত হননি তাদের এবং আভ্যন্তরীন পাহাড়ে যে উদ্বাস্ত রয়েছে তাদের পুর্নবাসন তো দুরের কথা যেখানে রয়ে গেছেন, সেখানে তাদের খাদ্যে নিরাপত্তা, চিকিৎসার নিরাপত্তা, পানির নিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অবশ্যই শরর্ণার্থী বিষয়ক টাস্কর্ফোস রয়েছেন কিন্ত টাস্কর্ফোসের কাজ তো নেই, সুপারিশও নেই। কাগজে কলমে শুধু তালিকা রয়েছে। এই অবহেলিত বিষয়টি জোরালোভাবে সরকারের কাছে আমি বলতে চাই এদিকে একটু নজর দিতে। এখানে এখনো খুবই করুণ অবস্থা রয়ে গেছে। তাদের একটি বড় অংশ সাজেক ইউনিয়ন রয়েছে।
ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, এক কথায় আমি যদি বলি পার্বত্য চুক্তির কিছুটা অগ্রগতি দেখা যায়। সরকার সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিস্পত্তিকল্পে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মতামত নিয়েই তা করেছে। এটাকে অবশ্য ভালো দিক বলা যায়। এছাড়া একটি রিটের রায়ে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৯০০ সালের আইনকে বৈধ এবং বলবৎ ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়গুলো এখনও অবাস্তবায়িত।
তিনি বলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামকে এখনও বেসামরিকীকরণ করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃংখলা জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। বিজিবির দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষার। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃংখলার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে চলেছে। এটা কাম্য নয়।
রাজা দেবাশীষ বলেন, পার্বত্য আঞ্চলিক ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন কার্যকর হয়নি। এসব পরিষদে নির্বাচন জরুরি। অথচ নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। পার্বত্য জেলা পুলিশ গঠন করা হয়নি। এছাড়া ভারত প্রত্যাগত ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি শরনার্থীদের নিজ নিজ জায়গায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। এ লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স থাকলেও কার্যত তা অচল। এসব বিষয় দ্রুত বাস্তবায়ন ও কার্যকর দরকার।