এক.
স্মরণাতীত কাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল আদিবাসী জুম্মদের আবাসভূমি হলেও এবং একদা এ ভূখন্ডে তারা স্বশাসিতভাবে বসবাস করলেও এক পর্যায়ে ক্রমাগতভাবে তারা জাতিগত আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি জেলা ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলটি প্রায় পুরোপুরি ব্রিটিশের শাসনাধীনে চলে আসে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকলেও এই এলাকাটি বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে এবং আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকে। কিছু বাংলাভাষি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক অভিবাসন হলেও তাতে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়নি।
কিন্তু পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে আদিবাসীদের সাথে আলোচনা ও সম্মতি ব্যতিরেকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে আদিবাসী জুম্মরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হলে জুম্মদের মধ্যে জাতিগত অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর জাতীয় সংসদের তরুণ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে আদিবাসী জুম্মরা তৎকালীন দেশের নীতি নির্ধারকদের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপন করে এবং জুম্মদের প্রথম রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। তারা প্রথমে সংসদে ও সংসদের বাইরে গণতান্ত্রিকভাবে দাবী আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে দেশের রাজনীতিতে পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে জুম্মদের এই আন্দোলন সশস্ত্র রূপ লাভ করে। বলাবাহুল্য, উপরোক্ত রক্তাক্ত ইতিহাস অনেকেরই জানা আছে।
কাজেই আমরা নি:শ্চয়ই ভুলে যাইনি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের একটা দীর্ঘ নিয়মতান্ত্রিক ও সশস্ত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংশ্লিষ্ট সকল মহল এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা হিসেবে স্বীকার করেন এবং সামরিক শক্তি দিয়ে দমন বা সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের নীতি গ্রহণ করেন। বিষয়টি অবশ্যই আর্ন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার গুরুত্ব আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। অবশ্য মানবাধিকার সচেতন আর্ন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল বা সংস্থাও এক্ষেত্রে যথেষ্ট ইতিবাচক উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। এই সমস্যাটি সমাধানের লক্ষেই ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। চুক্তিতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্বীকৃত হয় বা যে বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল-
(১) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য;
(২) পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা, এর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার;
(৩) চুক্তির আওতায় বিভিন্ন ধারায় বিবৃত ঐকমত্য ও পালনীয় দায়িত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী, রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন আইন মোতাবেক করা;
(৪) এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষে বিশেষ শাসনব্যবস্থা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে অধিকতর শক্তিশালীকরণ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়সহ এর সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’ গঠন। জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে বাংলাভাষিদের জন্য এক তৃতীয়াংশ ও জুম্মদের জন্য দুই তৃতীয়াংশ আসন বরাদ্দকরণ।
(৫) পার্বত্য চট্টগ্রামের জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একটি ল্যান্ড কমিশন গঠন। যে কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এযাবৎ সেসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে সে সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানাস্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকবে;
(৬) সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে প্রত্যাহার করা এবং এলক্ষে সময়-সীমা নির্ধারণ করা। কেবল নির্ধারিত প্রয়োজন সাপেক্ষে এবং আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ সাপেক্ষে যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা;
(৭) ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় (জুম্ম) শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন;
(৮) জেলা পরিষদের আওতায় ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়;
(৯) পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ কোন জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় ও হস্তান্তর না করা;
(১০) আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদসমূহ তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়, তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে সমন্বয়সাধন ও তত্ত্বাবধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তত্ত্বাবধান প্রভৃতি;
(১১) অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ কর্তৃক অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ এবং স্থায়ী বাসিন্দার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণ;
(১২) সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে গেলে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে ও ইহার পরামর্শক্রমে আইন প্রণয়ন। এমনকী তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়ন ও উপজাতীয় জনগণের কল্যাণের পথে বিরূপ ফল হতে পারে এমন আইন পরিবর্তন বা নতুন কোন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে পরিষদ সরকারের নিকট আবেদন করতে বা সুপারিশ দিতে পারে;
(১৩) ভূমিহীন জুম্ম পরিবারকে দুই একর করে ভূমির মালিকানা নিশ্চিতকরণ;
(১৪) জুম্ম কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখা এবং তার কর্মকান্ডকে জাতীয় পর্যায়ে বিকশিত করা;
(১৫) আদিবাসী জুম্মদের থেকে একজন মন্ত্রীসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা।
উক্ত বিষয়গুলোসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আরও অনেক বিষয়/বিভাগ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে আদিবাসী জুম্ম ও স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
চুক্তিটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যে সব ইতিবাচক অগ্রগতি বা পরিবর্তন হয় বা এর সম্ভাবনা দেখা দেয় সেগুলির মধ্যে বিশেষ করে কয়েকটি বিষয়কে নি¤েœাক্তভাবে উল্লেখ করা যায়-
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে চলা দুই দশকের অধিক সশস্ত্র সংঘাত এবং সংঘাতের কারণে উদ্ভূত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন নিরাপত্তাহীনতা ও নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির অবসান হয়।
সংঘাতের অবসানের ফলে মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবেশ সৃষ্টি এবং এর উন্নতি হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি ও অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই বিধানটি যথাযথভাবে কার্যকর হলে বিলুপ্তির মুখোমুখি আদিবাসী জুম্মরা তাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপন করার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা স্বীকৃত এবং এর প্রবর্তন হয়। এসব পরিষদসমূহ ও মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারলে এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে নি:সন্দেহে এক নবযুগের সূচনা সম্ভব হবে। শুধু এ অঞ্চলের মানুষ নয়, গোটা দেশের মানুষ এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমে ঐকমত্য হয়। এলক্ষে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। চুক্তি মোতাবেক সেনাক্যাম্প বা সেনা কর্তৃত্ব প্রত্যাহার করা হলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে ও মুক্ত পরিবেশে চলাচল করতে পারবে। ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে বহুগুণে অংশগ্রহণ বা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মানুষ আরও ব্যাপকভাবে গঠনমূলক ও অগ্রগতিমূলক কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এদেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কে পার্বত্যবাসী ও বহি:বিশ্বের ধারণাও আরও ইতিবাচক হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানে ঐকমত্য এবং এ ক্ষেত্রে সমস্যা নিরূপণ এবং তা সমাধানে পন্থা ও পদ্ধতি নির্ধারণ হয়। বস্তুত চুক্তির মধ্য দিয়েই ভূমি সমস্যা সমাধানের পন্থা ও পদ্ধতি সূত্রবদ্ধকরণ সম্ভব হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ভূমি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধিত হলে এবং সেই আইন ও চুক্তির আলোকে ভূমি কমিশন কাজ করলে আদিবাসী জুম্ম বা স্থায়ী বসতি বাঙালিরা যেমনি তাদের বেদখলকৃত ভূমি বা ভূমির অধিকার ফিরে পাবে, তেমনি ভূমি নিয়ে জটিলতা দূর হবে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল ও আগ্রাসন বন্ধ করা সহজ হবে।
এই প্রথম চুক্তির মধ্য দিয়ে স্থায়ী বসতি বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ও অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আদিবাসী জুম্মদের ন্যায় বস্তুত স্থায়ী বসতি বাঙালি জনগণও তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছে।
আদিবাসী জুম্ম ও স্থায়ী বসতি বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ও অধিকার যাতে নিশ্চিত থাকে সেজন্য ‘অ-উপজাতীয় (বাঙালি) স্থায়ী বসিন্দা’ নির্ধারণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার এবং নির্বাচন করার বিধান রাখা হয়েছে। এই বিধান যথাযথভাবে কার্যকর হলে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ তার যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারবে এবং এই অঞ্চলের প্রত্যেক জাতির মানুষের যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব হবে।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, সেনাক্যাম্পসহ সেনাশাসন প্রত্যাহার এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ কার্যকরকরণসহ চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্ভূত জাতিগত সমস্যার সমাধান হবে। পাশপাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও কৃত্রিমভাবে অভিবাসিত বাঙালিদেরকে পাহাড়িদের ভূমি থেকে প্রত্যাহারপূর্বক অন্যত্র সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের কাজটি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে হবে।
চুক্তি বাস্তবায়নসহ চুক্তির অনুকূূল বিভিন্ন গঠনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য সমস্যাটি সমাধান ও স্থিতিশীল পর্যায়ে উপনীত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধানের প্রক্রিয়াটি সারাবিশ্বের জাতিগত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হবে। বলাবাহুল্য, এতে দেশ, দেশের জনগণ ও সরকারই প্রশংসিত ও সম্মানিত হবে।
চুক্তিটি স্বাক্ষর করে উক্ত ভূখন্ডে শান্তি আনয়নের ক্ষেত্রে অবদান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার, ইন্দিরা গান্ধি শান্তি পুরস্কার লাভ করেছেন। এমনকী নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় নাম প্রস্তাব ওঠার কথাও মৃদুভাবে শোনা যায়। বলাবাহুল্য, এই পুরস্কার যেমনি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ, তেমনি এই চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্যকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। আরও উল্লেখ্য যে, তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলেরও অভিনন্দন পায় চুক্তিটি।
দুই.
কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগজনক যে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ সাড়ে ষোলো বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, চুক্তির কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কাজ বাস্তবায়ন করা হলেও সমস্যার সমাধান সম্পর্কিত চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও বাস্তবায়িত করা হয়নি। সবচেয়ে দু:খজনক হল, বিগত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বস্তুত বন্ধ ছিল বলাই সমীচিন। অথচ পাহাড়ি জুম্মরাসহ দেশের মানুষ জানে যে, সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্বে নির্বাচনী ইশতেহারে তার এই মেয়াদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। ক্ষমতায় আসার পরপরই সরকার বস্তুত কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ, উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ইত্যাদি পদসমূহে সরকার দলীয় লোকদের দিয়ে প্রতিস্থাপন করে আর তাতে চুক্তি বাস্তবায়ন করছে বলে প্রচার করতে থাকে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান বা বিষয়সমূহ যথাযথভাবে কার্যকর করণ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বা মূল মূল উদ্দেশ্য-লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন বা অর্জনের লক্ষ্যে বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য কোন আন্তরিকতা বা কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বস্তুত বিগত মহাজোট সরকারের ৫ বছর মেয়াদের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ কেবল কাপ্তাই ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারসহ ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং পূর্বে হস্তান্তরিত বিভাগের ৭টি প্রতিষ্ঠান/কর্ম তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্ত এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নে অসদিচ্ছা ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং উগ্র জাতীয়তবাদী শক্তি তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। এসব কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের মদদে ভূমিগ্রাসী বহিরাগত ব্যক্তি ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক কোম্পানী বান্দরবান জেলাসহ তিন পার্বত্য জেলায় জুম্মদের জুম ভূমিসহ রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়গা-জমি জবরদখলের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। তারা সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে জুম্মদের উপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এ সরকারের আমলে অন্তত: ৭টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। গত ৩ আগস্ট ২০১৩ তারিখে সংঘটিত মাটিরাঙ্গা-তাইন্দং-এর সাম্প্রদায়িক হামলা হলো তার সর্বশেষ ঘটনা।
অথচ সরকার বা সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বিগত পাঁচ বছর ধরে কেবল প্রতিশ্র“তি আর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে যান।
বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী আদিবাসী জুম্মদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার বা পদদলিত করে এবং প্রতারিত করে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নকে অবজ্ঞা করে কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারবে না, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না এবং দেশে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব হবে না। বস্তুত পার্বত্য সমস্যার যথাযথ সমাধান এবং এই অঞ্চলে যথার্থ শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
লেখক সজীব চাকমা সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি