খাগড়াছড়ি তথা তিন পার্বত্য জেলার অগ্রগন্য ব্যক্তিত্ব বরেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা প্রকাশ বরেণ ত্রিপুরা (৯৬) গতকাল বুধবার দুপুর নাগাদ প্রয়াত হয়েছেন। তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই ঠাকুরছড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবনে শিক্ষকতা, সাহিত্যচর্চা, সমাজসেবা ছাড়াও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ত্রিপুরার আগরতলায় মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হন।
তিনি দীর্ঘসময় বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সভাপতি, সা: সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অভ’তপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে বেশ কয়েক বছর খাগড়াছড়ি ও রামগড় এম ই স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করেন।
অত্যন্ত সমাজ অন্তপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব রাঙ্গামাটি শাহ মাল্টিলেটারেল হাইস্কুলের সেক্রেটারী, রাঙ্গামাটি গর্ভমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি:-র চেয়ারম্যান এবং রাঙ্গামাটি হিন্দু-বৌদ্ধ শ্মশান পরিচালনা কমিটির সভাপতি (১৯৫২-১৯৯০ সাল পর্যন্ত) ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সৃজনশীল পাঠ ও মননশীল বরেন ত্রিপুরা ইংরেজী ও বাংলায় সমান পারদর্শী ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা জনজাতির ইতিহাস সন্ধানে নিবেদিত হয়ে ১৯৭৮ সালে তাঁর সুসম্পাদনায় ‘পুব-ই রাবাইনি সাল (পূর্ব দিগন্তের সূর্য)’ নামের একটি ঋদ্ধ সংকলন প্রকাশ করেন। যা এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে সমান সমাদৃত।
বাংলা ও ত্রিপুরা ভাষায় গান, কবিতা রচনার পাশাপাশি তাঁর রচিত ‘দি ট্রিপুরাস অব চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস (১৯৭৭), অজানা পাহাড়ি সুর (১৯৬৬), বরোক (১৯৮১) এবং নুঙ কাচাকছার (১৯৯৬) অন্যতম।
তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ, রম্যরচনা, কথিকা, নাটক এবং কবিতা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া লেখালেখি জীবনে তিনি সিয়াই তোয় কুতুং, কুচুক হা সিকাম কামানি, জিজোঁক পুন্দা তান্নায়, জুয়াংফা, চেতুয়াংসহ ত্রিপুরাদের বেশ কিছু গীতিকাব্য ও পৌরণিক কাহিনী বাংলায় ভাষান্তর করেন।
তাঁর জীবদ্দশায় সমাজের নানা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ চলতি বছরের এপ্রিলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে তাঁকে গুণীজন সন্মাননা প্রদান করা হয়।
তিনি এতোটাই কর্মমুখর মানুষ ছিলেন যে, জীবনের শেষ বয়সেও নিজ গ্রামের উত্তর প্রজন্মের শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে ঠাকুরছড়া হাইস্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর দুই পুত্র এবং দুই কন্যা সকলেই শিক্ষা ও কর্মসফল করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর বড়ো সন্তান রণ বিক্রম ত্রিপুরা, একাত্তরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছোট ছেলে রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনিই পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক এবং সচিব হবার গৌরব অর্জন করেছেন।
দুই মেয়ের মধ্যে স্বপ্না রোয়াজা, ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রথম নারী গ্রাজুয়েট এবং কৃষ্ণা ত্রিপুরা, ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
তথ্যসূত্র: (বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভ’ষিত প্রভাংশু ত্রিপুরা রচিত গ্রন্থ ‘খাগড়াছড়ির মানস সম্পদ’)
লেখক: প্রদীপ চৌধুরী, সিনিয়র সংবাদকর্মী, খাগড়াছড়ি।