সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে। মেঘ ছুঁয়েছে পাহাড়। ঝরণা ছুঁয়েছে নদীকে। মেলেছে দু’হাত প্রকৃতির আধার। পিঠ বেয়ে চলেছে প্রশস্ত ঢালে সমতল ভূমি। বিস্তৃত উঁচু পাহাড়। জুড়েছে সবুজ প্রান্তর। সবুজে ঘেরা আর পাখপাখালিতে ভরা বনবাঁদাড়। নূুয়েছে মেঘবালিকা। পৃথিবীর এ যেন এক মনোরম ভূ-স্বর্গ। এ স্পটটির নাম সাজেকভ্যালি। বাংলাদেশের পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনা। সম্ভাবনার এ অঞ্চলটি কাজে লাগালে এটি হবে বাংলাদেশের দার্জিলিং।
ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়বেষ্টিত বিশাল উচুভূমির ওই সাজেকভ্যালির অবস্থান বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে। উপজেলা সদর থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। এটি এখন পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল। পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের এ অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সাজেকে পর্যটকদের অবকাশ যাপনে বিজিবির মারিশ্যা জোন স্থাপন করেছে রুইলুই রিসোর্ট। সম্প্রতি রিসোর্টটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে।
সমতলের নিচুভূমি থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উচু পাহাড় চুড়ায় অবস্থিত সাজেক। সাজেক পাহাড় চুড়া থেকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত দৃশ্য বিমোহিত করে ফেলে প্রকৃতি প্রেমীদের। দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন ওই সাজেক। এর আয়তন ৬০৭ বর্গমাইল। যা দেশের কিছু জেলার চেয়েও বড়। বর্তমানে মাত্র দশ হাজারের মতো লোকের বসবাস সাজেকে। সাজেকে ঢেউ খেলানো অসংখ্য উ”ু-নিচু পাহাড়। যেগুলো সবুজ বনানীতে ঘেরা। যা চোখ জুড়ানো নিসর্গ। পাহাড়ের বুক চিরে আপন মনে বয়ে চলেছে কাচালং ও মাচালং নামে ছোট দুটি নদী। নদী দুটির রুপ যেন সত্যিই পাহাড়ি কন্যার। দুটি নদীর বুকে প্রায় সব সময় ভাসতে দেখা যায় বাঁশের চালি। যা দৃষ্টি কাড়ে সবার চোখে। চালিতে বাঁধা বাঁশ সরাসরি চলে যায় কাপ্তাই লেক হয়ে কর্ণফুলি পেপার মিলে। আর পাহাড়ি পথ বেয়ে চলা রাস্তার দু’ধারে গড়ে উঠেছে স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রাম। সেসব গ্রামের জনমানুষের বৈচিত্রপূর্ণ জীবনধারা ঘিরে মুহূর্তেই আপ্লুত হয়ে ওঠে আগন্তুক পথচারীর আবেগ।
নির্মিতব্য থেগামুখ স্থলবন্দর সংলগ্ন এ অঞ্চলটি হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। চা বাগান, বনভূমি, ইকোপার্ক, পর্যটন মোটেল ইত্যাদি গড়ে তুলে বিশাল সম্ভাবনাময় এই জায়গাটি কাজে লাগানো গেলে আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও এলাকার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে।
সাজেকের পাশেই নির্মাণ করা হচ্ছে রাঙামাটি বরকলের ছোটহরিণা থেগামুখ স্থলবন্দর। সাজেকের এমন সম্ভাবনা কাজে লাগালে এটি হবে বাংলাদেশের দার্র্জিলিং। বিপুল সম্ভাব্যতার যাচাই শেষে এসব মন্তব্য করছেন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকবিদরা। সাজেকে এসে রাত যাপন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ দেশের অনেক বিশিষ্টজন অনেকে সরেজমিন সফর করেছেন সম্ভাবনাময় সাজেক। এ বছর ১২ ফেব্র“য়ারী সাজেক সফর করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ।
জানা যায়, সাজেক ভ্যালির সম্ভাবনা ঘিরে এর মধ্যে গড়ে তোলা হচ্ছে যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সাজেকের সংযোগ তৈরি হবে একদম সহজেই। সড়ক পথে ঢাকা থেকে যে কোনো পরিবহন খাগড়াছড়ি হয়ে যাবে সরাসরি সাজেকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অঞ্চলটি প্রসিদ্ধ হলে ঢাকা থেকে আকাশ পথে গড়ে তোলা যাবে বিমান চলাচলের ব্যবস্থা। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের যে কোনো অঞ্চল বা জায়গার সঙ্গে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেকের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে খুব সহজে সরাসরি। রাঙামাটি জেলা সদরের সঙ্গে সাজেকের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে সড়ক ও নদীপথে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট-মারিশ্য হয়ে সাজেক। আর নদীপথে রাঙামাটি-মাইনি-মারিশ্যা রুটে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর। সেখান থেকে আবার গড়ে তোলা হয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
সাজেকের চুড়ায় ওঠে দেখা যায় আকাশ থেকে পায়ের নিচে নামছে মেঘের ঢল। মেঘেরা ছুটোছুটি করে চলে মাথার ওপর। এমন দৃশ্য উদাস করে তোলে সবার মন। তখন যেন মনের গভীরে ছুঁয়ে যায় আনন্দের কোমল পরশ। এখন রাঙামাটির সাজেক পাহাড় দেখতে প্রায় সেখানে পাড়ি জমাচ্ছেন প্রকৃতি প্রেমীরা।
সম্প্রতি জনসাধারণের প্রত্যাশিত ও প্রিয় পর্যটন স্পট রুইলুই ভ্যালির উদ্বোধন করা হয়েছে।
জানা যায়, এক সময় সাজেক যাওয়া ছিল অনেকটা স্বপ্ন। কয়েক বছর আগে সড়ক নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এতে বদলে যেতে শুরু করে সাজেকবাসীর জীবনচিত্র। আর এখন সৌন্দর্য্য অবলোকনে পর্যটকরা যাচ্ছেন সরাসরি সাজেক। প্রকৃতির মিতালিতে হারিয়ে যেতে সাজেক পাড়ি জমাচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। সেজন্য পর্যটকদের ঘিরে সেনাবাহিনী গড়ে তুলছে পর্যটনের নানা অবকাঠামো। প্রশস্ত সড়ক, কটেজ, বিশ্রামাগার, সড়কবাতি, ক্লাবঘর, শিবমন্দির, পাবলিক টয়লেট, বিদেশী কটেজের আদলে তৈরি রিসোর্টসহ ইত্যাদি। “রুম্ময়”ও থ্রি স্টার মানের হোটেলও এ পাহাড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এখন। সাজেকের বাসিন্দা প্রায় অধিক লোকজন মিজো, লুসাই বা পাংখোয়া নামের গোষ্ঠীভূক্ত।
সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে সাজেকের নৈসর্গিক আবেশ উপভোগ করতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক যাচ্ছেন সাজেক। পর্যটদের মতে, সাজেক একটি সম্ভাবনাময় জনপদ। এর প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যকে কাজে লাগাতে পারলে সাজেক হতে পারে দেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সাজেকের কংলাকপাড়ার হেডম্যান চংমিং থাং লুসাই জানান, সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সাজেক পর্যন্ত রাস্তা হওয়ায় এলাকার চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে থেকে ৭ বছর আগেও সাজেকের মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য পাড়ি জমাতো ভারতের মিজোরামে। এখন সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় তাদের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে।
রুইলুই মৌজার হেডম্যান লাল থাংয়া লুসাই বলেন, সাজেকের সৌন্দর্যের টানে দেশের নানা এলাকা থেকে প্রতিদিনই পর্যটকরা যাচ্ছেন সেখানে। রুইলুই ভ্যালিতে এবার কোরবানি ঈদে যাবেন বহু পর্যটক। পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলে পর্যটকদের পদচারণা বাড়বে সাজেকে।
বিজিবির মারিশ্যা জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ রবিউল ইসলাম বলেন, সাজেকের রুইলুই ভ্যালিতে এখন বিপুলসংখ্যক পর্যটক আগমন শুরু হয়েছে। পর্যটকদের বিষয়টি মাথায় রেখে সেখানে ‘রুম্ময়’ নামে একটি মনোমুগ্ধকর রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
মারিশ্যা ও বাঘাই হাট জোন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামসুল ইসলামের নির্দেশনায় একটি জুনিয়র উচ্চবিদ্যালয়, পাংখোয়াদের বিনোদনের জন্য একটি ক্লাবঘর, বিশুদ্ধ পানির জন্য একটি পোর্ট এবল ওয়াটার ট্যাংক, স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের জন্য পাবলিক টয়লেট, পাবলিক লাইব্রেরী, রুইলুই এলাকায় বসবাসকারী পাংখোয়া ও ত্রিপুরাদের জন্য মডেল হাউজ, রেস্তোরা, শিবমন্দির ও সোলার প্যানেলের স্ট্রিট লাইট নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া খাগড়াছড়ি রিজিয়নের তত্ত্বাবধানে থ্রি স্টার মানের একটি রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত রিসোর্ট দুটি যে কোনো সময় সেনা প্রধান উদ্বোধন করবেন।
সব মিলিয়ে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার সাজেক এখন নতুন রুপে সাজানো হয়েছে পর্যটকদের জন্য। অনেকের মতে পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি সাজেক হতে পারে দেশের অন্যতম স্থলবন্দর।