যেকোন অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞেই ক্রেতা-ভোক্তার সুসম্পর্ক খুবই জরুরী। প্রয়োজন মানসন্মত দক্ষ ব্যবস্থাপনাও। বিশেষ করে পর্যটনের মতো বিশেষায়িত খাতে সাফল্যের জন্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় হলো বহুমাত্রিক অংশগ্রহণ, পরিবহন, সড়ক অবকাঠামো, সরকারী-বেসরকারী সমন্বয়, পরিবেশ-প্রকৃতির সুরক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা। এসবের কোন একটির আংশিক অভাব হলেই পর্যটন খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
বিগত এক দশকে ধীর লয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা দেশের সমতলের ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে পর্যটন সম্ভাবনাময় একটি জনপদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ এবং নানা মাধ্যমে এ জেলার সবকটি পর্যটন স্পট দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। সড়ক ও পরিবহন নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে খাগড়াছড়ির সাথে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অনেকগুলো জেলার সরাসরি যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।
ফলে প্রতিবছর খাগড়াছড়িতে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। আর পর্যটক বাড়ার সাথে সাথে পুরো জেলার পরিবহন, আবাসিক ও অনাবাসিক হোটেল, হস্ত ও কারু শিল্প, উৎপাদিত ফলমুল; এমনকি এখানকার শাক-সবজির ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এই যে নীরব অগ্রগতি ঘটার কারণ এবং ব্যকরণ খোঁজাও জরুরী। যে কোন বর্ধিষ্ণু খাতের সম্ভাবনার পাশাপাশি সংকটের সমাধান জানা না থাকলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
কেনো জানি খুব কাছ থেকে খাগড়াছড়ির সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতে সেই অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও পর্যটনের জন্য সুখ্যাত আলুটিলা ‘তেরাংতৈবাকলাই (রিছাং ঝর্ণা)’, দীঘিনালার তৈদু ঝর্ণা, সাজেক যাবার পথে হাজাছড়া ঝর্ণায় বছরের অধিকাংশ সময়ই জলপ্রবাহ থাকতো। চোখের অদেখা আর মনের অজান্তেই যেনো এইসব প্রাকৃতি পর্যটন স্পটের করুণ মৃত্যু ঘটে চলেছে। এইবার বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকেই খাগড়াছড়িতে মোটামুটি ভালোই বৃষ্টিপাত হয়েছে। এইটুক বৃষ্টিতেই প্রবল জলপ্রবাহ জেগে উঠার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেটি আর আগের মতো ঘটছে না।
অব্যাহত বেপরোয়া বন উজাড়, প্রাকৃতিক জঙ্গল কেটে মনোকালচার প্ল্যান্টেশন, একই পাহাড়ে উপুর্যপরি জুমচাষ এবং ঝর্ণার উৎসমুখের প্রাকৃতিক বৃক্ষ নিধন, ছোটবড়ো পাথর উত্তোলন; সব মিলে খাগড়াছড়িতে প্রকাশ্যে প্রকৃতি বিনাশের এক উৎসব চলছে।
আর এই বিনাশে ক্রমশ কমে আসতে পারে পর্যটকের সংখ্যাও।
এছাড়া রামগড় চা বাগান, মাটিরাঙার শতবর্ষী বটবৃক্ষ, মানিকছড়ির ঐতিহ্যবাহী মং রাজার বাড়ী, তিনট্যহরীর নান্দনিক বুদ্ধমুর্তি, পানছড়ির অরন্যকুটির, জিরোমাইল জেলা পরিষদ পার্ক, পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ; এসব মানবসৃষ্ট পর্যটন স্পটেও খুব বেশী ভালো ব্যবস্থাপনা আছে তা নয়।
আলুটিলা কেন্দ্রীক পর্যটকই মুলতঃ খাগড়াছড়ির জেলার জন্য এককভাবে বেশী। অথচ এই জনপ্রিয়-সুপরিচিত পর্যটন স্পটে বসার-থাকার কিংবা একটু ফ্রেশ হবার মতো কোনই ব্যবস্থা নেই।
অথচ খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরের সাজেক রুইলুইয়ে ভালো ব্যবস্থাপনার গুণে গড়ে উঠেছে অসাধারণ চমৎকার রিসোর্ট-বিশ্রামাগার। পর্যটকরা এখন খাগড়াছড়ির ওপর দিয়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সেই সাজেকেই। থাকা-খাওয়ার এবং নির্মল বিনোদনের ভালো আয়োজনের কারণে প্রতিদিন কতো-শতো মানুষ যে, সাজেকে ঢুঁ মারছেন, তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে-সাঝে কেউ কেউ এক-দুরাত খাগড়াছড়িতেও রাত কাটাচ্ছেন।
আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এর চেয়েও ভালো মানের রিসোর্ট, নিরিবিলি বিশ্রামাগার আলুটিলার সুউচ্চ চুড়া কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভগবান টিলায় গড়ে উঠতে পারে। এরজন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা, সদিচ্ছা এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।
পার্বত্য এলাকার অন্য দুই জেলা বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটন খাতের বিকাশ, খাগড়াছড়ির তুলনায় অন্ততঃ কয়েক’শ গুণ এগিয়ে গেছে। দিনকে দিন এই তফাত বাড়তেই থাকবে।
অথচ সরকারী বরাদ্দ, আইন ও কাঠামোগত দিক থেকে প্রায় একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও খাগড়াছড়ি কী এক অজানা কারণে পর্যটন খাতে পিছিয়ে পড়ছে!
এই শহরে যেকটি ব্যক্তি উদ্যোগে ভালো মানের হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে, তার সিংহভাগই নিজেদের স্বতস্ফুর্ততায়। এখানে কোন ব্যাংক বা সরকারী প্রতিষ্ঠান অথবা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কোনই প্রণোদনা ছিলোনা। এসব বেসরকারী উদ্যোক্তারা এখনো চেষ্টা করছেন, কীভাবে আরো বেশী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।
কিন্তু পর্যটন স্পটগুলোর সুরক্ষা, পর্যটন এলাকার দরিদ্র মানুষদের কর্মসংস্থান, স্পটগুলোর জন্য ত্বত্তাবধায়ক নিয়োগ, বিদ্যুৎ, পানি, যোগাযোগ অবকাঠামো, বিশ্রামাগার তৈরী; এসব নীতি-নির্ধারণী কাজ তো জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসনকেই করতে হবে।
এবং ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তার একটি বড়ো নজির স্থাপন করেছেন, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। তিনি প্রায় বছর খানেক আগে খাগড়াছড়ির তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ মাসুদ করিমকে সাথে নিয়ে নুনছড়ি দেবতা পুকুর পরিদর্শণে যান। সচরাচর হাজার খানেক ফুট উপরে হবার কারণে অনেক পর্যটকই এই ধেব পুকুর দর্শনে যেতে চান না। কিন্তু এই জেলার মানুষ হবার কারণে সাহস করে ছুটলেন। দেখলেন অসাধারণ স্পটির দুরাবস্থা। সেই থেকে এখন প্রতিবছরই দেবতাপুকুরে ওঠার সিঁড়ি ওপরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই বছরের ভেতর দেবতাপুকুরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
ভালো ব্যবস্থাপনার বিণিময়ে ভালো রাজস্ব আদায়ের পথও প্রশ্বস্ত হতে পারে। এই সহজ সমীকরণটি বুঝতে পারেন না শুধু খাগড়াছড়ির পলিসি মেকাররা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, পৌরসভা কতো ধরনের উন্নয়ন কাজ করে চলেছেন। এসব কর্তৃপক্ষ চাইলেই শহরের প্রাণকেন্দ্রে পর্যটকদের অভ্যর্থনার জন্য একটি ‘ট্যুরিজম হেল্পডেস্ক’ স্থাপন করা যেতে পারে। যেখানে ভ্রমণক্লান্ত মানুষরা এসে একটু বসবেন, ওয়াশরুম ব্যবহার করবেন। খাগড়াছড়ি শহর, পর্যটন স্পট, পরিবহন রুট, ভাড়া, থাকা-খাওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের তথ্য সহযোগিতা পেতে পারেন।
এমনকি কান হোটেলে সিট খালি অথবা ভাড়া কেমন, সরকারী কোন রেস্ট বা গেস্ট হাউজ অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন ডরমেটরী থাকলে সে সর্ম্পকেও তথ্য পেতে পারেন। এই ধরনের একটি ছোট উদ্যোগের কারণেও পর্যটন ব্যসায় বড়ো ধরনের সুফল বয়ে আসতে পারে।
গল্পের মতো একটা বাস্তব কাহিনী দিয়েই শেষ করি। পেশাগত পরিচিতির সূত্র ধরেই জনাদশেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ঢাকা থেকে এসে সাত সকালে খাগড়াছড়ি শহরে এসে নামলো। আগে থেকেই তাঁদের পরিকল্পনা তাঁরা কোন হোটেলে না উঠে যেকোন একটি পাবলিক অথবা প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় ফ্রেশ হয়ে নাস্তার পর্ব সারবে। আমি তাঁদের এই পরিকল্পনার সাথে দ্বিমত পোষণ না করেই রাজী হলাম। কিন্তু এই কাজতো খাগড়াছড়ি শহরে অসাধ্য। তাই নিয়ে এলাম নিজের বাসাতেই। আসার পথে তাঁরা খাগড়াছড়ি শহরের সুপরিসর-পরিচ্ছন্ন সড়ক অবকাঠামো দেখে খুব প্রশংসা করলো। কিন্তু যাবার বেলায় পর্যটকদের জন্য সরকারী-বেসরকারী উদ্যোক্তাদের কাছে অনুরোধ রেখে গিয়েছিলো, তাঁরা যেনো মধ্যবিত্ত, ছাত্র-ছাত্রী এবং শ্রমজীবি পর্যটকদের সামর্থ্যরে কথা চিন্তা করেন।
লেখক: প্রদীপ চৌধুরী, পাহাড়ের সংবাদকর্মী