৯ এপ্রিল বিকালের সময় জটিল অপারেশ এর পর অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছি ঢাকার ইডেন মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের ৫০৪ নং কেবিনে। ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় অপারেশন এর ১ দিন পোষ্ট অপারেশন অবজারভেশন রুমে রাখার পর ৮ এপ্রিল আমাকে তোলা হয় কেবিনে। তবে অপারেশন উত্তর অসহনীয় যন্ত্রনায় শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন ভেঙ্গে পড়ছে ঠিক এমনি যন্ত্রনা। ঘুমানোর হাজারো চেষ্ঠার পরেও চোখে এক ফোটা ঘুম নেই। ভালভাবে কথাও বলতে পারছিনা। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার সহ ধর্মিনী জাহেদা যিনি আমার সবচাইতে বড় সেবিকা মোবাইলে একটি টেলিফোন রিসিভ করে কার সাথে যেন কথা বলছে। তাঁর চোখেমুখে একটি বেদনার চিহ্ন ফুটে ঊঠেছে আবছা দৃষ্টিতে এটি বুঝতে অসুবিধা হলো না । অনেক কষ্ট করে জিজ্ঞেস করলাম মোবাইলের কথা । সরাসরি উত্তর না দিয়ে শুধু এটুকুই বললো রাঙামাটিতে তোমাদের একজন বড় সাংবাদিক সম্ভবত মারা গেছেন।
এরপর আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। । সেদিন রাতেই অ্ঞ্জন দাদা আমাকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন । তিনিও প্রথমে এই বিষয়ে প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও এক সময় বলতে বাধ্য হলেন শৈলেন দাদা পরলোকগমন করেছেন। তবে এই খবরটি আমার কানে না পৌছানোর জন্য সর্বাতœক চেষ্টা করা হয়েছে। তাই খবরটি আমাকে দেয়া হয়নি । এই খবর পেয়ে আমার অসুস্থ্যতা আরো বেড়ে যেতে পারে বলেই সবার ধারনা ছিল। তবে ৯ এপ্রিল রাতে এই খবর পাওয়ার পর আমি সম্পূর্ন নিশ্চূপ ছিলাম। একজন অতিপ্রিয়জনকে হারানোর শোকে আমি যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। দিন দুয়েক পড়ে যখন একটু একটু হাত পা নাড়াতে পারছিলাম তখন অনেক কষ্টে নোট বুকটি খুলে আমার মেইল চেক করলাম । মেইলে øেহভাজন লিটনের পাঠানো একটি ছবি দেখে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারিনি। দেখলাম আমার সাংবাদিকতা জীবনের গুরু শৈলেন দার নিথর দেহ হাসপাতালের ইমাজেন্সি রুমের একটি বিছানার উপর । শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত শৈলেন দার সেই ছবি দেখে মনে হচ্ছিল দাদা ঘুমাচ্ছে। তবে এই ঘুম যে আর কোন দিন ভাঙ্গবেরনা সেটি মনে আনতে পারছিলাম না। ইমার্জেন্সি রুমে যে বিছানায় দাদার নিথর দেহ পড়ে ছিল সেই বিছানেই ২৯ মার্চ আমাকে কিছুক্ষনের জন্য শোয়ানো হয়েছিল ডাক্তারী চেক আপের জন্য। তাই মনের শোকটা যেন উপচে পড়েছিল।
শৈলেন দাদার সাথে আমার পরিচয় :
১৯৯০ সনে এস.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করার পর রাঙামাটি সরকারী কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সাংবাদিকতা করার এক অদম্য স্পৃহা কাজ করছিল। আর তাই শরনাপন্ন হয়েছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাংবাদিক গড়ার কারখানা হিসাবে পরিচিত দৈনিক গিরিদর্পন পত্রিকার। পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন এ কে এম মকছুদ আহমেদের সাথে দেখা করে নিজের মনের কথা জানালাম। পরে বেশ কয়েকদিন গিরিদর্পন অফিসের সামনের কক্ষ রাঙামাটি প্রকাশনীর একটি টুলে বসেই কাটিয়েছে। তখনো শৈলেন দাদার সাথে পরিচয় হয়নি। মাস দুয়েক এভাবে প্রকাশনীতে বসার পর সাংবিকতার আমার অদম্য ইচ্ছা দেখে মকছুদ ভাই (বস) একদিন আমাকে ডেকে পরিচিয় করে দিলেন শৈলেন দাদার সাথে। বললেন দেখতো ছেলেটাকে সাংবাদিক বানানো যায় কিনা। সেদিনই শৈলেন দাদাকে খুব কাছ থেকে দেখলাম প্রথম দর্শনেই যেন তাঁর ভক্ত হয়ে গেলাম। মকছুদ ভাইয়ের রুমের পাশে হার্ডবোর্ডে পার্টিশন দেয়া ছোট্ট একটি কক্ষে গিরিদর্পনের নিঊজ ডেক্্র যেখানে তিনটি টেবিল। হাতওয়ালা একটি কাঠের চেয়ারের সামনে ছোট্ট একটি কাঠের টেবিল। আর এই চেয়ার ও টেবিলটিই হচ্ছে গিরিদর্পনের প্রাণ পুরুষ শৈলেন দাদার সাংবাদিকতার মূল স্থান। পাশে আরো ২ টি ছোট টেবিল । বরক পার্শ্বে একটি টেবিলে বসতো তাপসী দিদি । সেই প্রথম দেখায় মনে হলো তিনি আমাকে তাঁর শিষ্য হিসাবে গ্রহন করলেন। পরম øেহমাখা মুখে আমার বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করলেন । বললেন তুমি পারবে।
শৈলেন দাদার সেই অনুপ্রেরণা মূলত আমাকে সাংবাকিতা পেশায় আসার পথ সৃষ্টি করেছিল। সেই শুরু আর পিছনে তাকাতে হয়নি। কিছুদিন পরেই দাদার পাশে টেবিলে বসে নিউজ লেখার তালিম পেলাম দাদার কাছে। এক কথায় বলা যায় আমার সাংবাদিকতার হাতে কলমে শিক্ষা পেয়েছি শৈলেন দাদার কাছ থেকে সে হিসাবে তিনি আমার সাংবাদিকতার ওস্তাদ। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায় আশার পিছনে শ্রদ্ধাভাজন মকছুদ ভাই (বস) , অধ্যাপক আনিসুল হক (আমার শিক্ষক) , সুনীল কান্তি দে (প্রবীন সাংবাদিক) এর অবদান আমি কখনো ভূলতে পারবো না।
১৯৯১ সালের দিকে আমার যখন সাংবাদিকতা শুরু হয় তখন এই জেলায় হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন তাঁর মধ্যে সহকর্মী হিসাবে পেয়েছি পূলক, অলি ভাই এবং শামসু ভইকে। রানা ভাই অঞ্জনদা, ভুইয়া মোখলেছ-উর-রহমান, রুবেল ভাই, হরি দাদা, হারুন ভাই, শামীম রশীদ, মোহাম্মদ আলী, নজির আহমেদ তালুকদার, মঈন উদ্দিন ভূইয়া সহ আরো কয়েকজন । সবার কাছেই শৈলেন দাদা ছিলেন সাংবাদিকতার মূর্তিমান আদর্শ।
গিরিদর্পন ডেক্্ের ঢোকার পর শৈলেন দা পিআইবির একটি বুনিয়াদী প্রশিক্ষন গ্রহন করার পর ১ মাসের জন্য কক্্রবাজার গিয়েছিলেন। এখনো মনে পড়ে দাদা যখন কক্্রবাজার দেখে ফিরে আসলেন গিরিদর্পন কার্যালয়ে আমরা ফুল দিয়ে তাঁকে বরন করেছিলাম। প্রশিক্ষন গ্রহনের পর দাদা সংবাদ লিখন ও পরিবেশনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনলেন । আমাদেরকে ও সেই ভাবে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষন দিলেন। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দাদার একনিষ্ঠ ছাত্র হিসাবে সাংবাদিকতায় নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্ঠা করেছি। বিভিন্ন এসাইনমেন্টে দাদা আমাকে পাঠাতেন। এসাইনমেন্ট শেষ করে দাদার দিক নির্দেশনা অনুসরন করেই নিউজ প্রস্তুত করতাম।
দাদার হাত ধরেই ১৯৯২ সালে যোগদান করলাম দৈনিক বাংলার বানীর রাঙামাটি প্রতিনিধি হিসাবে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সনে যোগদান করলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনের বার্তা প্রতিনিধি হিসাবে। আমার প্রতিটি সাফল্যে সবচাইতে বেশী খুশি হতেন শৈলেন দাদা। গিরিদর্পনে যখন কাজ করি আমার প্রথম পদবী শহর সংবাদদাতা ঠিক করেছিলেন শৈলেন দাদা। পরবর্তীতে ষ্টাফ রিপোর্টার, মাঝখানে দাদার অনুপস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ১৯৯৮ সালের দিকে দাদার অনুমতি নিয়েই গিরিদর্পন পত্রিকার রেগুলার চাকুরী ছাড়ি কেননা সে সময় আমি রাঙামাটি শিশু নিকেতনের সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছিলাম। একদিকে শিক্ষকতা অপরদিকে বাংলার বানী ও বিটিভির প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের বিশাল দায়িত্বের কারনে গিরিদর্পন থেকে সাময়িক দূরে সরে এসেছিলাম । তবে গিরিদর্পনের সাথে সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি। কেননা এই গিরিদর্পনই যে আমার সাংবাদিকতা পেশার মূল পথিকৃত।
একজন শৈলেন দা এবং তাঁর সহজ সরল জীবন যাপন
শৈলেন দা সবসময় পরিপার্টি থাকতেন প্রতিদিন গিরিদর্পনে আসতেন ক্লিন সেভ অবস্থায়। ধবধবে ফর্সা, মাথাভর্তি কোকরানো চুল, টিপটপ পোষাক, হাতে একটি ব্যাগ এবং ব্যাগের মধ্যে বাটি ভর্তি পান এইসব কিছুই ছিল দাদার জীবনের অপরিহার্য্য অংশ। দাদার সাথে দীর্ঘ ৭ বছর একসাথে খুব কাছে থেকে দাদাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। শৈলেন দার পিতা মর্নোঞ্জন দে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন শহীদ বুদ্দিজীবি যা তিনি কখনো কাউকে বলতেন না। মাতৃভক্ত শৈলেন দাদা পরিবারের বড় সন্তান হিসাবে সবাইকে নিজ বুকে আগলিয়ে রেখেছিলেন। একটু দেরীতে বিয়ে করে সাংসারিক হলেও পরিবারের বন্ধনকে কখনো বিন্দুমাত্র সময়ের জন্য নষ্ট হতে দেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর আর এই স্বার্থপরতা ছিল পরিবারের সবাইকে একই সুতার বেঁধে রাখার স্বার্থপরতা ।
রুটিনে বাঁধা শৈলেন দাদার জীবন
শৈলেন দাদার সাংবাদিকতা জীবনের ৩৭ নবছরের মধ্যে দাদাকে খুব কাছ থেকেই দেখেছি বছর আটেক। এই আট বছর বছরের প্রতিটি মূহুর্ত একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা ছিল দাদার জীবন। সকাল ১০ টার মধ্যে গিরিদর্পনে এসে তাঁর টেবিলে বসেই শুরু সংবাদ লিখার কাজ । যেহেতু সে সময় কম্পিউটার ছিলনা এবং গিরিদর্পন প্রকাশিত হতো লেটার ব্লক প্রেসে সেহেতু হাতের লিখা নিউজ পাঠাতে হতো চট্টগ্রামের সদর ঘাটের প্রেসে। সেই সকাল থেকে এক নাগাড়ে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত চলতো বিরামহীন সংবাদ লিখা। আমরাও যে সব নিউজ করতাম সেগুলোও তিনি নিজ হাতে লিখতেন। বিকাল ৩ টার দিকে গিরিদর্পনের নিউজ প্যাকেট চট্টগ্রামের বিরতী হীন বাসে পাঠানোর পর কিছুক্ষনের জন্য বিরতী। এই বিরতীর সময় পাশের একটি হোটেল থেকে পরোটা আর ভাজি কিংবা ছুরি শুটকি আলু দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ করতেন দাদা। চা খুব একটা বেশী না খেলেও যে পরিমান পান খেতেন তা গননার বাইরে। অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এতো পান খাওয়ার পরেও দাদার ঠোট ও দাত দেখে বুঝার উপায় ছিলনা । বিকালে ঘন্টা খানেক বিরতির পর আবারো সেই কাগজ-কলম । পরবর্তী দিনের পত্রিকার ম্যাটার প্রস্তুতের জন্য আবার নিউজ প্রিন্টের পর বলপেনের সুন্দর টানা হাতের লিখা। রাত ৯ টার সময় শেষ হতো প্রতিদিনকার এই লেখার মহাযজ্ঞ । এটি ছিল প্রতিদিনকার দাদার রুটিন ওয়ার্ক। দাদা যে রুমে কাজ করতেন সেই রুমটিতে সব সময় বৈদুতিক লাইট জ্বালানো থাকতো । মাথার উপর ঘুরতো ফ্যান । কারেন্ট চলে গেলে এই কক্ষে এক মূহুর্তে থাকাও ছিল কষ্টকর । যে কারনে কারন চলে গেলেই আমরা সবাই কক্ষের বাইরে এসে সামনে বসতাম। কিন্তু ব্যতিক্্রম ছিলেন শৈলেন দাদা। কারেন্ট চলে গেলেও অসহ্য গরমের মধ্যেও তিনি সেই কক্ষেই মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করতেন। দাদার চুল যে কারনে সাদা হয়ে গিয়েছিল এটি ছিল তাঁর অন্যতম কারন।
শৈলেন দাদার সাংবাদিকতা :
শৈলেন দাদা ছিলেন অভিবিক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অ্ঞ্চলের একজন প্রতিষ্ঠিত প্রবীন সাংবাদিক। দীর্ঘ ৩৭ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে তিনি বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছেন দৈনিক গিরিদর্পন পত্রিকায় ।র্ তে দৈনিক আজাদী, দৈনিক ভোরের কাগজেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন । তাঁর সাংবাদিকতা জীবনে অনেক পত্রিকায় কাজ করার অফার আসলেও তিনি তা গ্রহন করেনি। বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতা পেশা যে পর্যায়ে পৌছেছে , নতুন পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেল বের হলেই কোন পত্রিকা ছেড়ে কোন পত্রিকায় যোগদান এই সব নিয়ে যখন এক অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা ঠিক সেই সময়ের জন্য শৈলেন দাদার সাংবাদিকতা সবার জন্য অনকেরনীয় হতে পারে। সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে কোন একঅভিমানে দাদা তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল গিরিদর্পন ত্যাগ করেছিলেন সেটি তিনি কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি। মাঝখানে কিছুদিন দৈনিক রাঙ্গামাটি পত্রিকায় কাজ করলেও এই পেশা সম্পর্কে শেষ সময়ে এসে তিনি কিছুটা যেন হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে সাংবাকিতার মূল পেশা থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান শৈলেন দাদা তাঁর অভিমানের কথা কখনো কাউকে বলেননি।
নির্লোভ, প্রচার বিমূখ শৈলেন দাদা :
শৈলেন দাদা ছিলেন একজন আপদমস্তক সাংবাদিক। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তারা এই পেশার পাশাপাশি অনেক সংগঠনের সাথে জড়িত । একাধিক পদ ও পদবীর ভারে সাংবাদিকতার পদবীটাও অনেকটা ছোট হয়ে আসে। কিন্তু শৈলেন দাদা ছিলেন এর সম্পূর্ন ব্যতিক্রম। তাঁকে অনেক প্রতিষ্ঠানের পদবী দেয়ার জন্য আগ্রহী হলেও তিনি অত্যন্ত সম্মানের সাথে তা প্রত্যাখান করিেছলেন। অনেক সাংবাদিক এর ওস্তাদ শৈলেন দাদা ছিলেন নৈপথ্যের নায়ক । নিজেকে সকল প্রকার প্রচার থেকে অনেক দূরে রাখতেন। খুব কম সংখ্যক অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা যেত । নিজেকে নিজের পছন্দের নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে বেঁধে রাখতেন। রাঙামাটি প্রেসক্লাবের একজন প্রবীন সদস্য হিসাবে প্রেসক্লাবে সভাপতি কিংবা সম্পাদক করার জন্য তাঁকে একাধিকবার রাজী করানোর চেষ্টা করেও সকলে আমরা সকলে ব্যর্থ হয়েছি। যেখানে প্রেসক্লাবের সভাপতি কিংবা সম্পাদক হওয়ার জন্য আমাদেও মধ্যে দুই বছর পর পর নির্বাচন আসলে একটি অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়। একবার পদ পেলে যেখানে এই পদ ছাড়াটা অনেকের কাছে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পদের জন্য লবিং, গ্র“পিং করে ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করে । সেই একই প্রেক্ষাপটে অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হওয়োর সূযোগ পেয়েও শৈলেন দাদা কখনো এই সব পদ গ্রহন করেননি। এটি ছিল তাঁ উদারতা। তবে তাঁ এই উদারতা আমাদের কতটুকু উদার করেছে তা এখন নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করি।
সাংবাদিকতা থেকে গবেষক এবং উন্নয়ন কর্মী
৩৭ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দাদা অতি কাছে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক কাছ থেকেই দেখেছেন এবং তাঁর লেখনির মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তা তুলে ধরেছেন সেগুলোর প্রতিটিই এক একটি প্রামান্য দলিল । পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের একজন জীবন্ত কিংবদন্তী ছিলেন শৈলেন দাদা। সাংবাদিকতা জীবনের উপর অভিমান করে কিছুটা সময়ের জন্য তিনি যোগ দিয়েছিলেন কপোসেবা সংঘে। এ্যাডভোকেট প্রতীম রায় পাম্পুর একান্ত অনুরোধে বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী আইন, কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষনা করার জন্য ছূটে গেছেন তিন পার্বত্য জেলার প্রতিটি প্রত্যন্ত এলাকায় । কপোসেবা সংঘের এই বিষয়ে যে প্রকাশনা তা এখন পর্যন্ত একটি অনন্য দলিল হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। এখানেও শৈলেন দার অবদান অনস্বী কার্য।
শৈলেন দার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কিছু হিসাব-নিকাশ
আগেই বলেছি শৈলেন দাদা ছিলেন একজন অতিমাত্রার চাপা স্ভাবের মানুষ। মনের মাঝে অনেক কষ্ট জমে থাকলেও কখনো তা তিনি কারো কাছে প্রকাশ করেননি । এইসব জমানো কষ্ট দাদার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুললেও দাদা ছিলেন নির্বিকার। দাদা তাঁর মনের কষ্ট কখনো কারো কাছে না বললেও দাদার খুব কাছে থাকার কারনে কিছুটা হলেও দাদার কিছু কষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম। একজন শহীদ পরিবারের সদস্য হয়েও দাদা এই পরিচয় কখনো কাউকে দিতেন না। মনে জমানো কোন এক কষ্টের কারনে দাদা এটি করতেন সেটি অজানাই রয়ে গেল। একজন শহীদ পরিবারের সদস্য হিসাবে দাদার পরিবারের সদস্যদেও যে সম্মান পাওয়ার কথা ছিল কখনো তিনি তা পাননি। যে কারনে ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর যখন জেলার শহীদ পরিবারদের সম্মাননা জানানো হতো তাঁর কেনাটিতে দাদা কিংবা তাঁর পরিবারের কেউ উপস্থিত থাকতেন না। শহীদ পরিবারের সূযোগ-সুবিধার জন্য কারো কাছে তিনি দ্বারস্থ হতেন না। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে আমাদের জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য প্রতিষ্ঠন গুলোও শহীদ মর্নোঞ্জন দে পরিবারের সদস্যদের কোন খবর রাখতেন না।
শৈলেন দাদা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পরবর্তীতে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসাবে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শৈলেন দা দীর্ঘদিন শাহ উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় একটি ভাড়া করে জীবন অতিবাহিত করেছেন । জীবনের শেষ দিকে এসে পরিবারের সকল পুঁজে দিয়ে দেবাশিষ নগর এলাকায় একটি বাসা কিনে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। অথচ পারিজাত কুসুম চাকমা যখন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তখন রাঙামাটির সাংবাদিকদের জন্য পুরাতন হাসপাতালের নার্সিং ট্রেনিং কোয়াটার এলাকায় একটি করে প্লট দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছিল । সেই আলোকে শৈলেন দাদা সহ আমরা একাধিক জন আবেদন করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল যেখানে আবেদনকারী সকলকে জায়গা দেয়ার কথা সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক ছড়া আর কাউকে জায়গা দেয়া হয়নি। সিনিয়র সাংবাদিক হওয়া সত্বেও শৈলেন দার জন্য একখন্ড জায়গা দেয়া হয়নি। সহকর্মীদের মধ্যে যারা জায়গা পেয়েছিলেন তারা প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন বাদ পড়া সাংবাদিকদের পর্যায়ক্রমে অন্যত্র জায়গা দেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিষয়ে আর কেউ অগ্রসর হয়নি। (যদিওবা সাংবাদিক কোটায় চিং কিউ রোয়ায জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থাকার সময় আমি এক খন্ড জায়গা বন্দোবস্তী পেয়েছিলাম) । এই ঘটনাটি শৈলেন দার মনে বিশাল আঘাত দিয়েছিল । যদিওবা তিনি তা কখনো প্রকাশ করেননি। সাংবাদিক শৈলেন দে পার্বত্যবাসীকে যা দিয়েগেছেন সে তূলনায় আমরা তাকে কিছুই দিতে পারিনি। তাঁর প্রাপ্তি আর প্রদানের খাতাটি বলা যায় প্রদানে পরিপূর্ণ প্রাপ্তিতে শুন্য।
আমার প্রতি ওস্তাদ শৈলেন দার ভালবাসাঃ
শৈলেন দা গর্ব সহকারে বলতেন আমি তাঁর অন্যতম শিষ্য । তিনি সবাইকে বলতেন আমি আমার আদর্শে মোস্তফাকে গড়ে তুলেছি । যখনি আমি কোন সমস্যায় পড়েছি তখনি তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বলা যায় তিনি ছিলেন আমার পরম শুভাকাংখী অভিভাবক ।
একজন শিষ্য হিসাবে আমার দুঃখ ঃ
২০১২ সালের জুলাই মাসে আমি হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন দেশে এবং দেশের বাইরে থাকার কারনে দাদার সাথে খুব একটা দেখা হতো না। তবে সব সময় তিনি অমার রোগমুক্তির প্রার্তনা করতেন। ভেবেছিলাম মার্চ মাসে দাদার বাসায় গিয়ে দাদার সাথে দেখা করবো। কিন্তু ২৬ মার্চ আবারো অসুস্থ্য হয়ে যাওয়া, চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ঢাকায় অবস্থান করা এবং বড় ধরনের অপারেশনের কারনে তা আর হয়ে উঠৈনি। হাসপাতালের বিছানায় বসেই শুনতে হলো আমার প্রিয় ওস্তাদের মৃত্যুর কথা। ওস্তাদের মুখটি শেষ বারের মতো দেখা হলোনা । অপারেশন শেষে ২০ এপ্রিল রাঙামাটি আসলেও শারীরিক অক্ষমতার কারনে ২৬ এপ্রিল দাদার স্মরন সভায় অংশ নিতে পারিনি। জানাতে পারিনি ওস্তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা । এই যন্ত্রনা আমাকে আজীবন কুঁকড়ে খাবে। দাদা আজ সকল কিছুর উর্ধ্বে । দাদার বয়োবৃদ্ধা মা আজ পুত্রশোকে কাতর। দাদার প্রিয়স্ত্রী আজ স্বামী হারা । দাদার দুই সন্তান আজ পিতা হারা। হয়তোবা জাগতিক নিয়মেই আমরাও কিছুদিনের মধ্যে ভুলে যাব শৈলেন দার কথা। আর এখানেই সমাপ্তি ঘটবে নির্লোভ, আদর্শবান একজন সাংবাদিক, শহীদ পরিবারের সন্তান শৈলেন দে এর চাপ্টার। এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু এই স্বাবাবিকতাই কি আমাদের কাম্য হতে পারে ? আমরা কি তাঁর মৃত্যুর পরেও একজন শহীদ পরিবারের সদস্য হিসাবে তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনা। আমরা কি পারিনা সাংবাদিক কোটায় তাঁর বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও সন্তানদের এক খন্ড মাথা গোঁজার জমি বন্দোবস্তী দিতে। দায়িত্ব কি নিতে পারিনা তাঁর প্রতিবন্ধী কন্যা শিশুটির? পারিনা তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে ?
পরিশেষে আমি আমার ওস্তাদ শৈলেন দার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে কেননা একজন শিষ্য হিসাবে ওস্তাদের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। মরন ব্যাধি রোগের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে আজ আমি নিজেই খুবই ক্লান্ত । দাদা আমায় ক্ষমা করবেন। আপনি তো এখন সকল ঠিকানার বাইরে। তবুও আমার এই মনো কষ্টের কথা যদি কখনো আপনার নজরে আসে তখন হলেও আমায় ক্ষমা করবেন।
শৈলেন দা, তুমি আজ নেই এই ধরণীতে
তবে তুমি বেঁচে থাকবে আজীবন
তোমার কীর্তিময় কর্ম জীবনের কারনে
স্মৃতির ক্যানভাসে তুমি থাকবে চির ভাস্কর।
লেখক
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও
ডি ডেইলি অবজারভার পত্রিকার রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি।