শুভ হোক রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা। একই সাথে শুভ কামনা রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শুভ যাত্রার। বাংলা ১৪২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের দেশের মঙ্গলময় ও সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনায় যখন দেশবাসী একনিষ্ঠ মনে একাগ্রচিত্তে দোয়া ও প্রার্থনারত ঠিক সেই বৈশাখ মাসেই পার্বত্যবাসীর জন্য দু-দুটি শুভ সংবাদকে বলা যায় ১৪২১ বঙ্গাব্দে রাঙামাটি তথা পার্বত্যবাসীর জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। এই উপহারের ফলে উন্মোচিত হয়েছে আমাদের এই এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার পথ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটি সফরে এসে মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যে ফলক উন্মোচন করেছিলেন এখন তারই বাস্তবায়ন হচ্ছে যদিওবা এই বাস্তবায়ন নিয়ে ছিল নানান সংশয়, বিভ্রান্তি। ছিল পেয়েও আবারো হারানো ভয়। তবে সকল সংশয়ের অবসান হয়ে নতুন পথ চলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় পার্বত্যবাসী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। পার্বত্যবাসীর প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার আন্তরিকতা স্থান পেয়েছে সকল কিছুর উর্ধ্বে।
বিগত ৯৬ হতে ২০০১ সালের মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন রাঙামাটিতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেকান্দার সাহেবকে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করলেও স্থানীয়ভাবে বিরোধীতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গার সংকটের কারণে তা হয়নি। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাঙামাটিতে প্রস্তাাবিত বিশ্ববিদ্যালয় অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় পার্বত্যবাসীকে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার আবারো ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর পাশাপাশি পার্বত্যবাসীর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের তৎকালীন পার্বত্যমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সরকারী সিদ্ধান্তের কথা জানান। যদিওবা সরকারের এই সিদ্ধান্ত আবারো বিরোধীতার মুখে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সরাসরি এর বিরোধীতায় মাঠে নামেন। তাদের দাবী আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন। পাশাপাশি এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কারণে নতুন করে যাতে কাউকে উদ্বাস্তু হতে না হয় সে দাবীও ছিল তাদের। অতি সম্প্রতি ঢাকার পরিচিত কয়েকজন বুদ্ধিজীবিও রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুিক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিরোধীতা করে প্রেস কনফারেন্স করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরোধীতা সরকারীভাবে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে চুক্তি বাস্তবায়নের চলমান প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখে যথাসম্ভব কাউকে যাতে নতুন করে উদ্বাস্তু হতে না হয় এবং যদি কিছু সংখ্যক লোকজনকে বৃহত্তর স্বার্থে নিজ জায়গা ছাড়তে হয় তাহলে তাদের পরিপূর্ণ পূনর্বাসনের দিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জায়গা নির্ধারন করার কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়। আর এই নির্দেশনা অনুযায়ীই বলা যায় মহাজোট সরকারের পুরো ৫ বছর প্রশাসন জায়গার সন্ধানে ছিল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপদেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একাধিক উপদেষ্টা একাধিকবার প্রস্তাাবিত এইসব জায়গা পরিদর্শন করেছেন। পাশাপাশি জেএসএস প্রধান সন্তু লারমার সাথেও আলোচনা চালিয়েছেন। তবে এ নিয়ে জেএসএস তাদের রাজনৈতিক অবস্থানে অটুট ছিলেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মানব বন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের নেতৃত্বেও হয়েছে মানব বন্ধন, বিভিন্ন সভা সমাবেশে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ, স্থাপনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন, তবে আশ্বর্যজনক হলেও সত্য যে, প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এই বিষয়ে ছিল একদম নিশ্চূপ । তবে কয়েকদিন আগে বিএনপির প্রধান ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সাথে ছাত্র সমাজের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পক্ষে মিছিল ও সমাবেশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন নিয়ে যখন পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান সৃষ্টি এবং এর বাস্তবায়নে সংশয় দেখা দেয় প্রথম থেকেই এমনকি ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাঙামাটি সফরে এসে যখন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ফলক উন্মোচন করেন এবং শহীদ শুক্কুর ষ্টেডিয়ামে ঘোষনা দেন তখনও অনেকের মনে সংশয় ছিল এই দুটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাস্তবায়ন নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ এর বিরোধীতাকারীদের তীর সবচেয়ে বেশী নিক্ষেপিত হয় সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের প্রতি। বলা যায় এই দুটি শিাা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সর্বাধিক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় দীপংকর তালুকদারকে। রাঙামাটির ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই এই ইস্যুকে নিয়ে দীপংকর তালুকদারের বিরোধীতায় অবস্থান নেয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীপংকর ঠেকাও রব উঠে। আর এতে পরাজিত হন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা দীপংকর তালুকদার। জেএসএস সমর্থিত উষাতন তালুকদার নির্বাচিত হন রাঙামাটি ২৯৯ নং সংসদীয় আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য হিসেবে।
এইসব জটিল সমীকরনের কারণেই পার্বত্যবাসীর মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন জাগে কি হবে মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে একনাগাড়ে দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্যবাসীর প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পিছপা হননি। নতুন উদ্যমে শুরু হয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের কাজ। আবারো শুরু হয় বিরোধীতা। তবে সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে এবার আর বিরোধীতা খুব শক্তিশালী হতে পারেনি। বিরোধীদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলোচনার কথাও শোনা গিয়েছে।
সর্বশেষ চলতি মে মাসে জারীকৃত একটি সরকারী প্রজ্ঞাপন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের যাত্রার পশের সকল বাধাকে পিছনে ঠেলে দেয়। ঘোষনা দেয়া হয় দেশের ২৯তম সরকারী মেডিকেল কলেজ হিসেবে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের শুভ যাত্রার কথা। ঘোষনা দেয়া হয় ২০১৪-১৫ শিক্ষা াবছরে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ৫০ জন শিক্ষাার্থী ভর্তির। স্থায়ী ক্যাম্পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত রাঙামাটি সদর হাসপাতালের পাশে অবস্থিত করনারী ইউনিট ভবনটিকে অস্থায়ী ক্যাম্পাস নির্বাচন করেই এখানেই মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু ও সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
মেডিকেল কলেজ এর কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগের পাশাপাশি শুরু হয় রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর কর্মসূচী। স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের আগে রাঙামাটি শহরের রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবনির্মিত একটি ত্রিতল ভবনকে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম পর্যায়ে ৩টি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স চালুর অনুমোদন নেয়া হয়। এখন অপেক্ষাা শুধুমাত্র প্রজ্ঞাপন জারীর।
তবে মেডিকেল কলেজ স্থাপন থেকে একধাপ এগিয়ে গেছে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ। রাঙ্গামাটি সদরের উপকণ্ঠে বালুখালী ইউনিয়নের হর্টিকালচার সেন্টারের পাশ্ববর্তী কাপ্তাই হ্রদ ঘেরা ৫০ একর জায়গা ইতোমধ্যে একুজিশন করেছেন সরকারের পক্ষে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন। ১০ মে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এম.পি প্রথম বারের মতো রাঙামাটি সফরে এসে। সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম এবং পার্বত্য সচিবসহ পরিদর্শন করেছেন প্রস্তাবিত জায়গা।
সরকারী সূত্রে জানা গেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক একুজিশনকৃত জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে এবং প্রকৃতির উপর কোনরূপ নেতিবাচক প্রভাব না ফেলেই নির্মাণ করা হবে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
একদিকে অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ আর তাঁর মধ্যেই আধুনিক প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্মত স্থাপত্য কলার আধুনিকতম প্রযুক্তি ও নিদর্শনকে সামনে রেখেই নির্মাণ করা হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এক কথায় হতে অপূর্ব। যেখানে প্রাকৃতিক কোলেই শিক্ষার্থীরা প্রকৃতিকে মনে প্রাণে লালন পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করবে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার স্থাপিত হতে যাওয়া এই দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পার্বত্যবাসীর ছেলে-মেয়েদের জন্য উচ্চ শিক্ষাার দ্বারকে উন্মোচিত করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পার্বত্য জেলার ছেলে-মেয়েরা অগ্রাধিকার পাবে এটাই স্বাভাবিক।
এতোদিন পার্বত্য এলাকায় যারা মেডিকেল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে লেখাপড়া করেছেন ব্যয় করেছে প্রচুর অর্থ এখন তাদের উত্তরসুরীরাই রাঙামাটিতে নিজ বাসায় থেকেই লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। পারি দিতে হবেনা শত শত মাইল, ব্যয় করতে হবে না কাড়ি কাড়ি টাকা। এর চাইতে বড় চাওয়া বা পাওয়ার আর কিবা থাকতে পারে?
মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠন এখনো বিরোধীতা করছেন। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরছেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটিও শুভ লক্ষন। মহান জাতীয় সংসদ এখন জেএসএস এর প্রতিনিধি হিসেবে উষাতন তালুকদার রয়েছেন এটি বিশাল ব্যাপার। তাই এখন আর বিরোধীতা নয় পারস্পরিক সমঝোতা মূলক আলোচনার মাধ্যমেই মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করতে হবে। আর পিছনে নয় প্রতিদ্বন্ধিতা মূলক বিশ্বে এখন এগিয়ে যাওয়ার সময়। প্রযুক্তি, বিদ্যা ও জ্ঞানে এগিয়ে যাওয়াই হোক আমাদের সকলের কাম্য।
(লেখক একজন সংবাদকর্মী ও শিক্ষক)
Pingback: Mongwai Marma