হিমেল চাকমা, অতিথি প্রতিবেদক। রাঙামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়ন। গ্রাম ৩৭টি। জনসংখ্যা ৮ হাজার ২শ ৭১ জন। প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০টি। এর মধ্যে ৯টি বেসরকারী। এই ইউনিয়নে সরকার মাধ্যমিক বিদ্যালয় না দিলেও ইউনিয়নের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে ৪টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছে। বিদ্যালয়গুলো; বসন্ত নিম্ন মাধ্যমিক, বাদলছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক, কাইন্দ্যা দৌজরী পাড়া নিম্ন মাধ্যমিক এবং কিল্ল্যামুড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ইউনিয়নে নেই কোন উচ্চ বিদ্যালয়। নেই কলেজ। নেই বিশ্ব বিদ্যালয়।
৪টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বসন্ত ও বাদলছড়ি বিদ্যালয় দুটি এমপিও তালিকাভুক্ত করেছে। ইউনিয়ন বাসী দীর্ঘ বছর ধরে উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতির দাবী করে আসলেও এখনও ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে ১৯৯৯ সালে স্থাপিত হওয়া কাইন্দ্যা দৌজরী পাড়া নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির স্বীকৃতি মিললেও এখনও এমপিও ভুক্ত হয়নি। এছাড়া কিল্ল্যামুড়া নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতিও মিলেনি।
এই অবস্থায় ঘর থেকে শুধু ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পাচ্ছে রাঙামাটি শহরকে ঘিরে থাকা সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের ছেলে মেয়েরা। ৯ ম শ্রেণীতে পড়তে হলে আসতে হচ্ছে রাঙামাটি শহরে। কৃষি নির্ভর এই ইউনিয়নের মানুষজনের পক্ষে শহরে বাড়ি ভাড়া করে পড়াশুনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ৮ম শ্রেণীতে পড়ে পড়াশুনা শেষ করতে হচ্ছে অনেককে। ঝড়ে পড়ছে শিক্ষা অর্জন থেকে। অনেকে আর্থিক টানা পোড়নের মধ্যে ছেলেমেয়েদের রাঙামাটি শহরে রেখে পড়াশুনা অব্যহত রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর সংখ্যা তেমন বেশী নয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে কাইন্দ্যা দৌজরী পাড়া নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সমাবেশে দাঁড়িয়ে ডান হাত মুস্তিবদ্ধ করে শপথ করছে দেশকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে। শপথ শেষে জাতীয় সংগীতে মুখরিত করে তুলেছে কাইন্দ্যার বিদ্যালয়ের আশাপাশ। সমাবেশ শেষে বাঁশের বেড়া আর টিন দিয়ে তৈরি করা বিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষে বসে ক্লাশ করছে।
বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণী ছাত্রী জীপা চাকমা বলেন, কাল বৈশাখী আর বর্ষাকাল আসলে তাদের নিয়মিত স্কুলে আসা সম্ভব হয় না। ক্লাশ চলাকালে বিগত কয়েকটি কাল বৈশাখীতে স্কুলের চাউনীর টিনগুলো উড়ে গেছে। পরদিন এগুলো কুড়িয়ে আনতে হয়েছে। এখন বৃষ্টি হলে শ্রেণীকক্ষে পানি পড়ে। জানালার ডাকনা না থাকায় বাতাসের সাথে পানি শ্রেণীকক্ষে এসে বইখাতা কাপড় ভিজিয়ে দেয়।
একই শ্রেণীর রিকেল চাকমা বলেন প্রতিদিন প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে স্কুলে আসে। বর্ষাকালে কাদা আর ছড়ার পানি বৃদ্ধির কারণে আসতে পারে না। স্কুলে যদি থাকার ব্যবস্থা হয় তাহলে ভাল হয়।
বিদ্যালয়ের তথ্যমতে ২০০২ সালে এটি পাঠদানের অনুমতি পায়। ২০০৫ সালে এটি স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু এখনও সরকারীভাবে ভবন নির্মাণ হয়নি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারের কোন ভাতা পায় না। এলাকার মানুষের দেওয়া চাউল আর আর্থিক অনুদান দিয়ে রাখা হয়েছে ৫ জন খন্ডকালীন শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু চাকমা বলেন, তাদের স্কুলটি এমপিও হয়নি। এলাকার মানুষদের দেওয়া সম্মানী দিয়ে ৫ জন শিক্ষক মিলে বিদ্যালয়টির ক্লাশ চালাচ্ছেন। এই সম্মানী দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হলেও এলাকার ছেলে মেয়ে আর অবিভাবকদের মুখ দেখে তারা বিদ্যালয়টিতে আছেন।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি গান্দীলাল চাকমা বলেন, প্রতি হাটের দিনে যারা বাজারে যায় তারা ফিরার সময় বোটে (ইঞ্জিন চালিতদেশীয় নৌকা) দায়িত্বে থাকা একজন টিকিটের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে। এলাকার ৩ শ পরিবার প্রতিমাসে ১ কেজি করে চাউল দেয়। এছাড়া বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজ থেকে টাকা সংগ্রহ করে শিক্ষকের বেতন তহবিলে জমা দেয়। এই তহবিল থেকে প্রতিমাসে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। শিক্ষকদের থাকা খাওয়া নিজেরা ব্যবস্থা করেন এলাকার শিক্ষার্থীর অবিভাবকরা।
বালুখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিজয়গিরি চাকমা বলেন, ইউনিয়নটি সদর উপজেলায় হলেও এখনও শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছনে পড়ে আছে। সরকারের কাছে বার বার দাবী করার পর নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো এমপিও হচ্ছে না। উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না।
পুরো জেলার মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা অনুসন্ধানে জানা যায়, রাঙামাটি জেলার ১০ উপজেলার ৫০ টি ইউনিয়নের দুই তৃতীয়াংশ ইউনিয়নের এই অবস্থা। পুরো জেলায় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৫টি। রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙামাটি সঃ বাঃ উচ্চ বিদ্যালয়, জুরাছড়ি ভুবনজয় সঃ উঃ বিদ্যালয়, লংগদু সঃ উঃ বিদ্যালয় এবং রাজস্থলী তাইতং পাড়া সঃ উঃ বিদ্যালয়। রাঙামাটি শহরে সরকারী দুটি উচ্চ বিদ্যালয়ের মত বাকী ৩টি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থা বেশ নাজুক। নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। শূন্য পড়ে আছে একাধিক শিক্ষকের পদ। বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও নেই বিজ্ঞান শিক্ষক। পরীক্ষাগারে নেই যন্ত্রপাতি।
জুরাছড়ি ভুবনজয় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছে মাত্র ২ জন, লংগদু উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ জন, রাজস্থলী ৪ জন।
সরকারী বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা জানালেন তাদের কষ্টের কথা। রাজস্থলী তাইতং পাড়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বানীব্রত চৌধুরী বলেন, শিক্ষকের শূণ্যপদ গুলো বছরের পর বছর শূণ্য পড়ে থাকায় বিদ্যালয়ের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। লংগদু সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বৃষক কুমার চাকমাও বানীব্রত চৌধুরীর সুরে কষ্টের কথা বললেন। তিনি বলেন, শিক্ষকের পাশাপাশি এমএলএসএসের কাজ করতে হচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী পরিদর্শক অনুতোষ চাকমা রাঙামাটি মাধ্যমিক শিক্ষার দুরবস্থার কথা একবাক্য স্বীকার করে বলেন, শুধু গাইন্দ্যা কেন? রাঙামাটি পুরো জেলার অবস্থা একই। জেলায় যেসব নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে সেগুলোর এমপিওভুক্ত এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেওয়া জরুরী। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের নি¤œ মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বছরের পর বছর বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন। সরেজমিনে গিয়ে না দেখলে তা বুঝা যায় না। সমতলে এক মাইলে মধ্যে একাধিক স্কুল চোখে পড়ে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে মাইলের পর মাইল হাটলেও স্কুল চোখে পড়ে না। যা চোখে পড়ে তারও নাজুক অবস্থা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোগলিক ও জনসংখ্যা অনুপাতে বহু জায়গায় একাধিক উচ্চ বিদ্যালয় জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন কিন্তু তা হচ্ছে না।
অবিভাবকরা টাকা তুলে দিয়ে বছরের পর বছর বিদ্যালয়ে শিক্ষক রাখছেন। একদিকে শিক্ষকের বেতন অন্যদিকে ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ যোগানো সব মিলে খুব কষ্ট করছে অবিভাবকরা। এদের কষ্ট দেখলে নিজের কষ্ট লাগলেও এসব নিরসন করা সরকার ছাড়া জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সম্ভব নয়।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চরম অবস্থায় আছে। জেলার সব উপজেলায় এখনও কলেজ স্থাপন হয়নি। যা আছে সেগুলোর অবস্থাও বেশ নাজুক। রাঙামাটি সরকারী ও মহিলা কলেজ ছাড়া কোন সরকারী কলেজ নেই। এগুলোর প্রতি কোন নজর না দিয়ে সরকার জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় করছে। পার্বত্যবাসী এর বিরোধীতা করছে। তারা উচ্চ শিক্ষা বিরোধীতা করছে না। তারা চাচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হোক। কিন্তু সরকার তা না করে উল্টো কাজটা করছে। সরকার পাহাড়ে শিক্ষা বিস্তারে আন্তরিক হলে শিক্ষার নিচের স্তর ঠিক করছে না কেন? পার্বত্যবাসীকে ঘর না দিয়ে গাড়ি দেওয়া হচ্ছে সরকার এমন অবস্থা সৃষ্টি করছে।
রাঙামাটি জেলা সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা অঞ্জুলিখা খীসা বলেন, বর্তমানে দেশে শিক্ষার যে নীতিমালা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট তা মিলছে না। সমতলের একজন শিক্ষক দুর্গম পার্বত্য এলাকায় গিয়ে শিক্ষকের চাকুরী করছে তার সংখ্যা খুব কম। পার্বত্য এলাকার এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোসহ শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকারের কোন পদক্ষেপ নেই বললে চলে। দেশে সমতলের অনেক জায়গায় রাতারাতি বিদ্যালয় গড়ে উঠে তা রেজি; এমপিও সবকিছু হচ্ছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যালয়গুলোর প্রতি কোন নজর নেই। ফলে যুগ যুগ ধরে পার্বত্যাঞ্চল পিছিয়ে পড়ে আছে।
জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার দুরবস্থার কথা স্বীকার করে তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, তিনি যখনই সময় পান তখন সংশ্লিষ্টদের কাছে পাহাড়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের পক্ষে দাবী তুলেন।