প্রকৃতির সৌন্দর্য্যর অপরুপ দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র খ্যাত রাঙামাটি কি দিনকে দিন অভিভাবক হীন হয়ে পড়ছে? এই প্রশ্ন এখন রাঙামাটির সচেতন মহলের । সুষ্ঠ এবং সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভাগ গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সর্বোপরি একশ্রেণীর লোকজনের মাঝে অধিক বানিজ্যিকায়নের চিন্তাভাবনার কাছে রাঙামাটি এখন জিস্মি হয়ে পড়েছে। একদা তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটি শহর এর অবস্থান এক নম্বরে থাকলেও এখন তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটির অবস্থান অন্য দুই জেলার চাইতেও খারাপ। যেখানে অন্য দুই পার্বত্য জেলা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে পরিছন্নতা এবং পর্যটন সেক্টরে উন্নয়নের চূড়ান্ত ধাপে উন্নীত হচ্ছে সেখানে রাঙামাটির অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো । রাঙামাটির উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও উন্নয়ন কাজে নেই কোন সুষ্ঠুু পরিকল্পনা, আছে শুধু অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা।
বাংলাদেশের মধ্যে এখন কোন জেলা শহর সর্বাধিক অপরিচ্ছন্ন ? এই প্রশ্নের উত্তরে যে কয়েকটি জেলা সদরের নাম উঠে আসবে তার মধ্যে রাঙামাটির অবস্থান শীর্ষে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাঙামাটির এই অপরিছন্নতার ব্যাপারে রাঙামাটি জেলার সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান প্রতিটি সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতেন রাঙামাটি শহরটি এখন আবর্জনার শহরে পরিনত হয়েছে। পাশাপাশি কাপ্তাই হ্রদ পরিনত হয়েছে ময়লা ফেলার ভাগাড়ে। এভাবে চলতে থাকলে রাঙামাটি খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার অতীতের সকল সুনাম হারাবে। রাঙামাটির নবাগত জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনর রশিদ ও রাঙামাটি শহরকে পরিছন্ন রাখার বিষয়ে কয়েকটি সভায় কথা বলেছেন এবং এপ্রিল মাস হতে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করার আশা ব্যক্ত করেছেন।
রাঙামাটি শহরের সৌন্দর্য দেখা শোনা করার দায়িত্ব কার ? এ বিষযটি এখন রাঙামাটি বাসীর কাছে সবচাইতে বড় প্রশ্ন । রাঙামাটিতে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সব কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে এবং একশ্রেণীর মানুষের মাঝে শহরকে ধ্বংস করার যে নি¤œ মন মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ১৩ জুনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর রাঙামাটির যে ভগ্নদশার সৃষ্টি হয়েছে তাতে রাঙামাটির প্রাকৃতিক পরিবেশের এমনিতে চূড়ান্ত বারোটা বেজেছে । কিন্ত এরপরও এই প্রাকৃতিক দূর্যোগ এর ভয়াহতা দেখেও আমরা কোন শিক্ষা পেয়েছি বলে মনে হয়না। দূর্যোগের পরপরই প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রাঙামাটির বিভিন্ন সড়ক গুলোতে বল্লি মেরে এবং মাটি ফেলে যে রক্ষণাবেক্ষনের কাজ করা হয়েছে তার অধিকাংশ ছয় মাস না যেতেই ধ্বংস হতে চলেছে । ২ কোটিরও বেশী টাকা ব্যয়ে শালবাগান এলাকায় যে বেইলি ব্রীজ নির্মান করা হয়েছে সেটিও এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে । সামনে বর্ষা মৌসুমে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে কয়দিন যান চলাচল করতে পারবে সেটি এখন সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
দূর্যোগ সংগঠিত হওয়ার পরপরই একাধিক সরকারী এবং বেসরকারী দপ্তরের উদ্যোগে দূর্যোগের কারন এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একাধিক সভা, সেমিনার, পরিকল্পনা সভা করা হলেও এসব সভা সেমিনারের কোন সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এখনো রাঙামাটির বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে যেভাবে লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে তাতে যে কোন মূহুর্তে আবারো আরেকটি ১৩ জুন ট্রাজেডি সৃষ্টি হতে পারে।
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী সড়ক এলাকা দিয়ে রাঙামাটি শহরে প্রবেশ করলে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে রাঙামাটি শহরটি কি ভ্রাম্যমান বাজারের শহর। ভেদভেদী থেকে কাঁঠালতলী এলাকা পর্যন্ত সড়কের দুপাশে যে ভাবে ভ্রাম্যমান বাজারের সম্প্রসারণ ঘটছে তাতে অনেকেই আতংকিত হয়ে পড়ছেন। পথচারীদের জন্য রাস্তার দুপাশে ফুটপাত করা হলেও রাঙামাটির ফুটপাত গুলোর সিংহভাগই এখন অধর পথচারীদেও জন্য নেই। এসব ফুটপাত এখন ভ্রাম্যমান বাজারের দখলে নতুবা অ¯’ায়ী টি স্টল কিংবা ঠেলা গাড়ী কিংবা নির্মান সামগ্রী রাখার স্থানে পরিনত হয়েছে। কয়েকজায়গায় ফুটপাতের উপরই স্থায়ী অবকাঠামো নির্মান করা হয়েছে । সকলের চোখের সামনে রাঙামাটির পথচারীদের চলাচলের জন্য নির্মিত ফুটপাত গুলো দখল হয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোন কর্তৃপক্ষের নজর নেই। বিভিন্ন সভায় এ সব বিষয় আলোচিত হরৌ সভার কার্য বিবরণীতেই এই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে।
দেশের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন ময়লা এবং বর্জ্য সাধারনত দৃশ্যমান স্থানে না ফেলে অন্যত্র ফেলা হলেও রাঙামাটির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন । এখানে কি বসতবাড়ী, কি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সবার ব্যবহার্য ময়লাগুলো ফেলা হয় মূল সড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে । আবার বিভিন্ন জায়গায় ময়লা ফেলার ডাস্টবিন গুলোও রাস্তার পাশের ফুটপাতের উপর গড়ে উঠেছে। মনে হয় রাঙামাটির এসব ময়লা এবং বর্জ্য গুলো যেন দৃশ্যমান করার মধ্যেই আনন্দ । ময়লা অপসারনের সময় জন সমস্যার সৃষ্টি না হয় সেদিকে নজর রাখার কথা থাকলেও কারো কোন নজর নেই।
রাঙামাটি শহরের পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর প্রধান কার্যালয়ের পর তিন রাস্তার মোড় হতে রাঙামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা পর্যন্ত এলাকাটিকে রাঙামাটির ভ্রাম্যমান রান্না ঘর বললে ভুল হবেনা। এই এলাকায় রাঙামাটি শিশু পার্কটিও এখন ভ্রাম্যমান রন্ধন শালায় পরিনত হয়েছে। পুরো এলাকার সড়ক জুড়ে দুপাশে অসংখ্য বাস যেভাবে এলাপাথাড়ি ভাবে রাখা হয় তাতে মনে হতে পাওে এটি রাঙামাটির বাসস্টেশন। রাঙামাটিতে একটি বাস টার্মিনাল থাকলেও এ বাস টার্মিনালের ব্যাপারে এরা জানেই না।
রাঙামাটি শহীদ শুক্কুর স্টেডিয়ামের পূর্বপাশে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটকদের রান্না বান্নার কাজ চলছে নির্বিঘেœ । রাস্তার পাশের চুলা বানিয়ে সেখানেই কুটনা কুটা, বাটনা বাটা থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া সবকিছুই হচ্ছে । এর ফলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং শহীদ শুক্কুর স্টেডিয়াম সব সময় ময়লা আবর্জণার স্তুপে পরিনত থাকে। এখানেও কারো কোন নজর নেই।
রাঙামাটি শিশু পার্কে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর পক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা অধিক ব্যয়ে একটি টয়লেট নির্মান করা হলেও এ টয়লেট সর্বদা থাকে তালাবন্দী । তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন এই টয়লেট নির্মান করা হয়েছে। অথচ এখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক আসলেও পর্যটকদের ব্যবহার করার মতো কোন পাবলিক টয়লেট নেই। নেই পানির কোন ব্যবস্থা।
রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলী ফিসারী বাঁধ এলাকা সড়কটি এমনিতে ঝুঁকিপূর্ণ । সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর এ সড়ক বাঁথের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সড়কের এশাধিক অংশে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। কথা ছিল সড়ক বাঁধ এলাকায় কোন নৌযান ভীড়ানো যাবেনা কিংবা নৌযানের জন্য মালামাল লোডিং আনলোডিং করা যাবেনা। কিন্তু কথা থাকলেও ঘটেছে ঠিক উল্টোটি। এই সড়ক বাঁধ এলাকার বিশাল অংশ জুড়ে এখন স্পিড বোর্ড ঘাট, বাঁধের একটি অংশে রীতিমত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালামাল লোডিং আনলোডিং এখন সর্বদা দৃশ্যমান। তবে সাধারন জনগনের কাছে এহগুলো দৃশ্যমান হলেও দায়িত্ববান প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির কাছে এগুলো এখন অব্দি অদৃশ্যমান । রাঙামাটি পৌর ট্রাক টামিনাল এখন টার্মিনাল এলাকা ছেড়ে সড়ক বাঁধ এলাকায় পৌছেছে কিন্তু এখানেও বিধি বাম। দেখার কেউ নেই।
রাঙামাটিকে পর্যটন শহর বলা হয়। বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা প্রায়শ বলেন রাঙামাটি শহর পর্যটক বান্ধব । কিন্ত আদৌ এটি সঠিক কিনা সে বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন রয়ে গেছে। যেখানে পর্যটকদের নূন্যতম সূযোগ-সুবিধা নেই কিংবা পর্যটনের উন্নয়নের নামে উন্নয়নের সুফল পর্যটকেরা পাননা সেখানে এটি পর্যটন বান্ধব শহর কিভাবে হতে পারে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাঙামাটিতে পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর খরচ অনেক ক্ষেত্রে কক্সবাজারের চাইতেও বেশী।
রাঙামাটিতে পর্যটন হলিডে নামক একটি সরকারী স্থাপনা রয়েছে। এ পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স এলাকায় আগত প্রতিটি গাড়ীকে দিতে হয় উচ্চ হারে টোল। মান্ধাতার আমলের ঝুলন্ত সেতু (বর্তমানে প্রায় সময় ডুবন্ত থাকে) পারাপারে দিতে হয় জনপ্রতি ২০ টাকা। অথচ এখানে পর্যটকদের জন্য নূন্যতম কোন সুবিধা নেই। পর্যটন কর্পোরেশন প্রায় ১২ কোটি টাকার ব্যয়ে হলিডে কমপ্লেক্স এর খোলা জায়গায় নির্মান করে একটি আবাসিক হোটেল। অথচ এর ফলে এই জায়গায় পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর যে সূযোগ ছিল সেটিও নস্ট হয়ে গেছে। অবিবেচকের মতো এই আবাসিক ভভন নির্মান করা হয়। রাঙামাটির পর্যটন এর উন্নয়ন নিয়ে কোন ভাবনা পর্যটন কর্পোরেশনের আছে বলে মনে হয়না। গত ৯ বছরে রাঙামাটিতে পর্যটনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় গন একটি বারের জন্যও রাঙামাটি আসেননি। বর্তমানে রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের অব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, পর্যটকের এখানে আর উচ্চ হারে ভাড়া কিংবা খাবার বিল পরিশোধ করে থাকতে রাজী নন।
রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন নিয়ে এখানে যথেষ্ট পরিমানে দড়ি টানাটানি হয় । পর্যটনের উন্নয়নের দায়িত্ব কার ? এখানে পর্যটন এর বস কে এই সব বিষয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ কিংবা মান অভিমানের কথা শোনা গেলেও পর্যটনের উন্নয়নের জন্য কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। সবাই ব্যস্ত ক্ষমতার মোহে।
রাঙামাটিতে একাধিক সরকারী সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার কাঠামো একই সাথে বিরাজমান থাকায় এখানে প্রায়শ সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠে। রাঙামাটির অনেক সাধারন জনগন এখনো জানেনা কোন সমস্যার সমাধান কারা করবে ? অনুরুপভাবে এখানে উন্নয়ন কাজেও রয়েছে চরম সমন্বয়হীনতা। এমনো দেখা গেছে এখানকার উন্নয়ন জনগনের চাহিদার প্রেক্ষিতে নয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কর্তার ইচ্ছের উপর নির্ভর করে সরকারী উন্নয়ন প্রকল্প।
রাঙামাটি বাসী এখন এমন অবস্থায় রয়েছে যেখান থেকে তারা উত্তোরণের পথ খুঁজছে । সহজ সরল রাঙামাটি বাসী এতোসব জটিল হিসেব বুঝে না । তারা চায় একটি পরিছন্ন রাঙামাটি শহর । কর্র্তৃপক্ষের মধ্যকার দড়ি টানাটানির জটিলতা তাদের বোধগম্য নয়। ফুটপাতে পথচারী থাকবে। সড়কে যানবাহন চলবে , এ শহর একটি ভ্রাম্যমান বাসস্টেশন, বাজার কিংবা রন্ধণশালায় পরিনত হবে না —- এটিই তাদের প্রত্যাশা। প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্বান অভিভাবক পাবে রাঙামাটি বাসী এটি তাদের দাবী।
লেখক: মোস্তফা কামাল, সিনিয়র সাংবাদিক, রাঙামাটি।