বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায় ধারাবাহিক সাহিত্যচর্চার ইতিহাস এখনো তেমন জোরালো নয়। খুবই সংকুচিত সৃজনশীল প্রকাশনার জগতও। তবে বাংলা ভাষায় লেখালেখি করে সুনাম কুড়িয়েছেন এমন অনেকেই আছেন। এইতো বিশিষ্ট লেখক ‘প্রভাংশু ত্রিপুরা’ গেলো বছর জয় করেছেন, বাংলা একাডেমী পুরস্কার। তাঁর মতো আকাশ ছুঁতে না পারলেও দীর্ঘদিন বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন এমন অসংখ্য উজ্জল মুখের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
সর্বশেষ গত বছরের ১ নভেম্বর রাঙামাটি জেলাশহরে তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসী লেখকদের নিয়ে একটি বর্ণাঢ্য লেখক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
‘লেখনির ছোঁয়ায় জেগে উঠুক আদিবাসী প্রাণ’ শীর্ষক শ্লোগানকে সামনে রেখে প্রকাশ করা হয়, একটি স্মারক সংকলন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি’র ব্যানারে আয়োজিত এবং লেখক বিপম চাকমা’র সম্পাদনায় প্রকাশিত স্মারক সংকলনে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-ভ্রমণ কাহিনী-গীতি কবিতা ও স্মৃতিকথা মিলিয়ে ৬৬ জন লেখকের লেখা।
এরমধ্যে চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-তঞ্চঙ্গ্যা-¤্রাে-খিয়াং-চাক-খুমী সম্প্রদায়ের লেখা ছিলো। বাদ পড়েছে বেশ ক’টি সম্প্রদায়ের পাশাপাশি চাকমা-মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অনেক পরিচিত লেখকের লেখাও।
২’শ ৫০ পৃষ্ঠারও বেশী কলেবর নিয়ে প্রকাশিত সংকলনটিতে মাতৃভাষার বর্ণমালায় লেখা ছিলো মাত্র দুজনের। এরমধ্যে একজন বান্দরবানের প্রবীন লেখক ক্য শৈ প্রু এবং খাগড়াছড়ির অলিন্দ্র ত্রিপুরার।
শুধু তাই নয়, ২৪টি কবিতাসহ একটি দীর্ঘ গল্প প্রকাশিত হয়েছে বাংলা হরফে চাকমা ভাষায়। আর বাদ বাকী সব লেখাই বাংলা ভাষার।
এই প্রকাশনার সূত্র ধরে বলা চলে, তিন পার্বত্য জেলাতে লেখালেখির ভাষা হিসেবে বাংলা যেমন জনপ্রিয় তেমনি লেখকরাও বাংলা লিখতে বেশ পারঙ্গম।
একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মননশীল ছোট কাগজ ‘সমুজ্জল সুবাতাস’, রাঙামাটি ‘জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল (জাক)’ বিভিন্ন প্রকাশনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের অনিয়মিত সংকলন, দীপায়ন খীসা সম্পাদিত ‘মাওরুম’, কবি আলোড়ন খীসা সম্পাদিত ‘হুচ্’ এবং খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সান্তুআ জার্ণাল’সহ অধিকাংশ প্রকাশনাতেই আদিবাসী মাতৃভাষার বর্ণমালায় লেখা উপস্থিতি একেবারে স্বল্প।
লেখক-পাঠকদের সাথে কথা বলেও বোঝা গেছে, এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়-আশয় নিয়ে সুরচিত গল্প-উপন্যাসের মধ্যে বিপ্রদাশ বড়–য়া অনেক বেশী জনপ্রিয়।
তরুণ লেখক কে. ভি. দেবাশীষ মনে করেন, দেশের অনেক বোদ্ধা লেখকই তাঁদের সৃজনশীল শব্দাঞ্জলীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের রুপকল্প তুলে ধরার সৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। কোন কোন লেখায় উঠে এসেছে পাহাড়ের গুমরে কাঁদার অজানা-অপ্রকাশিত সাহসী বয়ানও। তবে সেসব লেখকদের অনেক-ই হয়তো এক-দুবার পাহাড়ে এসেছেন। সেক্ষেত্রে নন্দলাল শর্মা, বিপ্রদাশ বড়–য়া এবং ‘অরণ্যে সুবাসিত ফুল’র সম্পাদক কবি হাফিজ রশিদ খান এবং গল্পকার খোকন কায়সার পাহাড়ী জনপদের লেখচিত্র অংকনের জন্য দিনের পর দিন, মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়েছেন।
‘বনযোগীছড়া কিশোর-কিশোরী কল্যাণ সমিতি’ পার্বত্য চট্টগ্রামের সৃজনশীলতার চর্চা, প্রকাশনা ও লেখালেখিতে উজ্জল এক প্রতিষ্ঠান। রাঙামাটি জেলাশহর থেকে পানিপথে ঘন্টা পাড়ি দিয়েই যেতে হয়। জুড়াছড়ি উপজেলার বনযোগী ছড়া’র প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সংগঠনটি গত দেড় দশক ধরে ১২টিরও বেশী সৃজনশীল সংকলন প্রকাশ করেছে। চিত্র মোহন চাকমা’র মতো পাহাড়ের নিভৃতচারী লেখক, সেই গ্রামেই বেঁচে আছেন।
‘বনযোগীছড়া কিশোর-কিশোরী কল্যাণ সমিতি’র অন্যতম সংগঠক কবি নির্মল চাকমা জানান, তাঁদের প্রকাশনায় চাকমা বর্ণমালায় লেখালেখির প্রবণতা বেশ লক্ষ্যনীয়। কারণ চেতনাগত দিক থেকেই সংগঠনটি চাকমা বর্ণমালার প্রচার-প্রসারে দায়বদ্ধ ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
বাংলা বর্ণমালায় চাকমা ভাষার চর্চার প্রবণতাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে নারাজ কবি ও ব্লগার আলোড়ন খীসা। তিনি মনে করেন, দেশে বাংলা ছাড়া অন্যসব ভাষার বর্ণমালা ও ভাষার চর্চা গৌণতর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এগোচ্ছে। তাছাড়া একজন চাকমা-মারমা-গারো-সাঁওতাল বা ত্রিপুরা শিশুতো সরকারীভাবে এখ নপর্যন্ত মাতৃভাষার বর্ণমালা শেখার সুযোগও পাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আগেকার পরিস্থিতি তো আরো নাজুক ছিলো।
অনুভুতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে, বেশী পাঠক ও মানুষের কাছে আদিবাসী সাহিত্য-সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে আপাত দৃষ্টিতে এটাকে মেনে নেয়ারই পক্ষে তিনি।