শিরোনামঃ

বীরশ্রেষ্ঠ রউফের সমাধির নিঃস্বার্থ পাহারাদার দয়াল চাকমা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চান

ফজলুর রহমান রাজন,রাঙামাটি। মানুষ বড় স্বার্থপর, খুব কম মানুষই আছেন নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অপরের জন্য কাজ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা এবং যে মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে দেশের সাত বীর শ্রেষ্ঠ সন্তানের একজন মুন্সি আব্দুর রউফের মৃতদেহ সনাক্ত করে ৪২ বছর ধরে কবর আকড়ে ধরে আছেন সেই দয়াল কৃষ্ণ চাকমা জীবনের শেষ সময় এসে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চান।Rangamati Doyal pic-05 রক্তের সম্পর্কের কেউ না, তবুও ৪২ বছর ধরে একটি কবরের দেখভাল করছেন দয়াল কৃষ্ণ চাকমা। 

ঘটনার ২৭ বছর পর ১৯৯৭ সালে দয়ালের মাধ্যমেই এই কবরটির ‘সন্ধান’ পায় তৎকালীন সরকার। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত দয়াল জানতেন না, কবরের মানুষটির পরিচয়। শুধু জানতেন, লোকটি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু লোকটি যে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি পেয়েছেন তা-ও ছিল তাঁর অজানা। পরে সরকারি উদ্যোগে সংস্কার করা হয় এই বীরের সমাধি। তবু কবরটিকে ছেড়ে যাননি বয়সের ভারে ন্যুব্জ দয়াল। এখনো তিনি পাহারাদারের মতোই আগলে রেখেছেন সমাধিকে।
দয়াল কৃষ্ণ চাকমা জানান, এখনো চোখ বন্ধ করলে তিনি ফিরে যান একাত্তরের সেই দিনটিতে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে একদল বাঙালি যুবকের তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধের দৃশ্য। সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে গিয়ে কিভাবে জীবন দিলেন মুন্সী আবদুর রউফ তাও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর।
দয়াল আরো জানান, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল। প্রতিদিনের মতোই সেদিনও কাজের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ দেখতে পান বুড়িঘাটের চেঙ্গী নদীতে কয়েকটি সুসজ্জিত-শক্তিশালী নৌযান ও গানভোটে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা এলাকায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নৌযানগুলো থেকে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ভয়ে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকেন দয়াল। আর দেখতে থাকেন অসম অস্ত্রধারী দুই পক্ষের যুদ্ধ। বাঙালি যোদ্ধাদের প্রতিরোধে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট নদীতেই ধ্বংস হয়ে যায়। আহত-নিহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। একপর্যায়ে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সেনা এলে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে শুরু করেন। কমান্ডার চিৎকার করে সবাইকে পিছু হটতে নির্দেশ দিলে মুন্সী আবদুর রউফ (দয়াল তখনো এই নাম জানতেন না) পাল্টা জবাব দেন, ‘আমি ওদের (পাকিস্তানি বাহিনী) ঠেকিয়ে রাখছি, আপনি পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে নিরাপদে পিছু হটে যান।’ তখন দলের অন্তত ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা পিছু হটলে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন রউফ। হঠাৎ বিকট শব্দে মর্টারের কয়েকটি শেল আঘাত হানে আবদুর রউফের ওপর। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী ফিরে গেলে গাছ থেকে নামেন দয়াল। চোখের সামনে এক সাহসী মুক্তিযোদ্ধার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে মনটা কেঁদে ওঠে তাঁর। পরম যতেœ সেই অচেনা মুক্তিযোদ্ধা যুবকের লাশ কবরে সমাহিত করেন তিনি। ওই দিনই পথ হারিয়ে ফেলা তিন মুক্তিযোদ্ধাকেও তিনি নিজের বাসায় দিয়েছিলেন আশ্রয়।munsi abdur rouf kabar
যেভাবে খোঁজ মিলল বীরশ্রেষ্ঠর কবরের : ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি উদ্যোগে শুরু হয় সব বীরশ্রেষ্ঠর কবর খুঁজে বের করার কাজ। মুন্সী আবদুর রউফের কবর খুঁজতে গিয়ে সেই সময়ের বুড়িঘাট যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা ও বর্তমানে রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর শরণাপন্ন হয় সরকারের লোকজন। তাঁর দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রথমে দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে খুঁজে বের করা হয়। দয়ালের সহযোগিতায়ই খোঁজ মিলে মুন্সী আবদুর রউফের কবরের। সেই সময়ই এই সমাধির সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা হয়। কিছু আর্থিক সহায়তা পান দয়ালও।
একজন বীরশ্রেষ্ঠর দাফন সম্পন্ন করে দীর্ঘদিন সেই কবরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পথহারা মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চিনিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করার স্বীকৃতি হিসেবে দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন করার আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়। নানিয়ারচর উপজেলা প্রশাসন ও রাঙামাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু তার পরও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ঠাঁই হয়নি দয়ালের। এমনকি মুন্সী আবদুর রউফের সমাধির তত্ত্বাবধান করার বিনিময়ে কিছু মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্র“তি থাকলেও তা ঠিকমত পান না বলে জানিয়েছেন দয়াল। তিনি জানান, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে কখনো ৫০০, কখনো বা এক হাজার টাকা দেওয়া হয় তাঁকে। এ ছাড়া আর কোনো সরকারি সহায়তা তিনি পান না।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে লেখালেখি করেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এত বছরেও এই কাজটি হয়নি। এটা আমাদের সবার জন্যই আসলে লজ্জার।’
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম না ওঠা কিংবা সরকারি সহায়তা না পাওয়ায়ও কারো প্রতি কোনো অভিমান নেই দয়াল কৃষ্ণ চাকমার। সংসারের শত টানাপড়েনের মধ্যেও মনের আনন্দেই রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধি।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 517 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen