শিরোনামঃ

বাংলাদেশ ভারত পানি যুদ্ধ : সেলিম সারোয়ার

বাংলাদেশ বহু সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও সচরাচর তার জনগোষ্ঠীর সামাজিক মনোজগত আচ্ছন্ন থাকে রাজনীতি দ্বারা। আর সেই ‘রাজনীতি’ও মুখ্যত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। এটা এখানকারBook_Review_mar_28-2m সমাজের এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা।
বর্তমানে বাংলাদেশে অতীত যেকোন সময়ের চেয়ে আরও অধিক রাজনৈতিক উত্তাপ বইছে। নিরবিচ্ছিন্ন হত্যা-জ্বালাও-পোড়াও-গুম-খুন ইত্যাদির ভেতর দিয়েই এগোচ্ছে দেশ।
এরকম একটি সময়ে পানিকেন্দ্রিক কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন কতটুকু জাতীয় মনোযোগ পাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সেই বিবেচনায় আলতাফ পারভেজ ঝুঁকি নিয়েছেন বলা যায়। অনেকটা ভুল সময়ে একটি জরুরি প্রসঙ্গ সামনে আনতে তৎপর হয়েছেন লেখক।
লেখক শুরুতেই স্বীকার করেছেন, পানিবিজ্ঞানের ছাত্র নন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের পানিবিবাদের ময়নাতদন্ত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার আসন্ন পানি সংকটের পুরো চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি বিস্তর কারিগরী উপাত্তসহ।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে ছয়টি অধ্যায় রয়েছে এরকম:

এক.
দক্ষিণ এশিয়ার পানি ব্যবস্থাপনা, পানি-কূটনীতি ও
আসন্ন পানিযুদ্ধ

দুই.
ফারাক্কা ব্যারাজ: বাংলাদেশ যখন কৃতজ্ঞতার ফাঁদে

তিন.
টিপাইমুখ বহুমুখী প্রকল্প: সরাসরি ঝুঁকিতে বাংলাদেশের
আট হাজার বর্গমাইল

চার.
কেন-বেতোয়া কৃত্রিম সংযোগ খাল, ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প
এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব পর্যালোচনা

পাঁচ.
তিস্তা চুক্তি অনিশ্চিত;
যদিও করিডর সুবিধা পেয়ে গেছে ভারত

ছয়.
আন্তর্জাতিক পানি আইন ও প্রথার আলোকে
বাংলাদেশ-ভারত পানি বিবাদ

উপরোক্ত প্রতিটি অধ্যায়ই লেখা হয়েছে কয়েক দশকের প্রয়োজনীয় কারিগরী তথ্যসহ। পাশাপাশি এসেছে বাংলাদেশ-ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার পানিকেন্দ্রিক কূটনীতির আদ্যপান্ত। বইটির দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখেছেন দেশের নদীরক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হাসনাত কাইয়ূম। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পানিনীতি ও পানি সুরক্ষা কৌশলের ঐতিহাসিক এক মূল্যায়ন হাজির করেছেন যা গ্রন্থের গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
এটা আমরা জানি এবং হরহামেশা গণমাধ্যমে শুনি যে, বাংলাদেশের গ্রামজীবন মানেই পানিবিধৌত সভ্যতা। বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ যদি বলা হয় গ্রামকেÑ তা হলে তার প্রাণভোমরা বলতে হবে পানির উৎসগুলোকে। পুকুর, দিঘী, খাল, নদীই গ্রামীণ বাংলার প্রাণশক্তি। আর এগুলোকেই যেন ছায়া দিয়ে রেখেছে পাশের সমুদ্র।
বিশ্বের অনেক দেশেই নদী, খাল, সাগর রয়েছে। কিন্তু নদী প্রবাহের উপর প্রাণ বৈচিত্র্যের এত সর্বগ্রাসী নির্ভরশীলতা নিয়ে গড়ে ওঠা সভ্যতা আছে অল্পইÑ যেমনটি ঘটেছে আমাদের এখানে। কিন্তু বাংলার সেই পানিশক্তিতে ভয়ংকর রকমে টান পড়েছে। জালের মতো থাকা নদী মানচিত্রটি উধাও হতে বসেছে বাংলাদেশ থেকে। অনেক জেলাতেই নদী আছে কেবল জ্যেষ্ঠদের স্মৃতিতে। বাস্তবের নদী উধাও। এতে দেশের স্বাভাবিক অর্থনীতির ধারা পাল্টে যাচ্ছে। জীবনধারা বদলে যাচ্ছে। প্রাণ বৈচিত্র্য নিঃশেষ হচ্ছে। সংস্কৃতির উৎসমুখেও টান পড়েছে। বস্তুত নদীগুলো শুকিয়ে এই জনপদের ঐতিহাসিক ইকোসিস্টেম প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এসবই ঘটছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকারে নয়Ñ মনুষ্য সৃষ্টি ধ্বংসলীলা রূপে।
জীবনধারার এই ভূমিকম্পতুল্য পরিবর্তনের মূলে রয়েছে পানি প্রবাহের নিঃশেষ। এ গ্রন্থ সেই পর্যবেক্ষণের আংশিক বয়ান মাত্র। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পানি বিষয়ে সম্প্রতি আলতাফ পারভেজ অনেক বিশ্লেষণাত্মক রিপোর্ট লিখেছেন। সেগুলোর কয়েকটি এই গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। এখানে কেবল প্রধান প্রধান নদীগুলো নিয়ে আন্তর্দেশীয় রাজনীতির খেলাটুকু, নির্মম কূটনীতিটুকু চুম্বক আকারে হাজির করার চেষ্টা করা হলেওÑ সেসব একটিভিস্টদের এটা ভালোই কাজে লাগবে যারা বাংলার নদীনালার ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে লড়ছেন ।
প্রতিবেদনগুলো নির্মোহ হলেও লেখকের আবেগের উত্তাপটুকু খোলামেলা ভাবেই বোঝা যায় ভূমিকায়। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন. ‘দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো চলতি পানিযুদ্ধে নীরবতা পালনের নীতি নিয়েছে। দু’একটি বামপন্থী সংগঠনের কিছু সংগ্রামী উদ্যোগ ছাড়া ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ ধ্বংসলীলা মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। নতুন শতাব্দির দ্বিতীয় দশকে এসে বাংলাদেশে রাজনীতির এই মোটাদাগের মোড় পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার, বাঁধ-ড্যাম-পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে মূলধারার রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবীতা মুখে কুলুপ এঁটেছে। মিডিয়াকে ভর করে ‘পানি বিজ্ঞানী’ সেজে অনেকে নানান কুযুক্তির আড়ালে ভাটি অববাহিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। পানিশূন্যতায়, নদীহত্যায় বাংলাদেশ কীভাবে বাঁচবে তা নিয়ে পুরোপুরি উদাসীন দেশের প্রধান প্রধান গবেষণাকেন্দ্রগুলো। যে জনপদ হাজার বছরের পানির ধারা আর পলি থেকে তার প্রাণ বৈচিত্র্যকে নির্মাণ করেছেÑ আগামীতে পানিবিহীন নগরজীবনে তার জন্য কী ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে সে সম্পর্কে নাগরিক সমাজও বিস্ময়কর রকমে উদ্বেগহীন। সম্ভবত এটা কোন অসচেতনতা নয়Ñ এটাই সচেতন বুদ্ধিজীবীতা, এটাই বাংলাদেশের চলতি রাজনীতির প্রধান দিকÑ পানি দস্যুতায় নীরব থাকতে হবে।’
আলোচ্যগ্রন্থ নিঃসন্দেহে সেই নীরবতার দেয়ালে মৃদু এক ঘণ্টাধ্বনি। যদি কেউ শুনতে পায়। শুনতে চায়।
প্রকাশনা হিসেবে এটা অতি ক্ষুদ্র আয়তনের। এই গ্রীষ্মে এত ছোট ফ্রেমে দেশের মূল সংকটে আলো ফেলা সত্যি অনন্য এক চেষ্টা হয়েছে। যা একদিক থেকে খুবই পাঠক-বান্ধব। চটজলতি পড়ে ফেলার মতো। প্রচ্ছদটি অসাধারণ এক শোকগাথার স্মারক। এককালের ¯্রােতস্বিনী তিস্তা যখন মরা বালুচর। দামও কম বইটির। এর বহুল প্রচার কাম্য।

বাংলাদেশ-ভারত পানিযুদ্ধ
আলতাফ পারভেজ
প্রকাশক : তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা।
প্রচ্ছদ: মিঠু আহমেদ
মূল্য : ১২০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১০
আইএসবিএন : ৯৮৪ ৭০২২৫০০৮১ ৮

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 550 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen