শিরোনামঃ

প্রসঙ্গ : রাঙামাটির ঝুঁকিময় পরিবেশ

প্রাকৃতিক বিপর্যয় নাকি মানব সৃষ্ট বিপর্যয় ? মোঃ মোস্তফা কামাল

সাম্প্রতিক সময়ে প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট রাঙামাটি শহরের দূর্যোগ রাঙামাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মাঝে শংকার সৃষ্টি করেছে । কেননা এই দুর্যোগে শহরের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসের কারনে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে সবার মনে একই প্রশ্ন ? মাঝারী বর্ষনেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে প্রবল বর্ষনে কি হবে রাঙামাটির অবস্থা ? তবেMostafa55 copy এই প্রশ্নের মাঝেই আরেকটি ছোট্ট প্রশ্ন সেটি হচ্ছে রাঙামাটির এই বিপর্যয় কি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয় নাকি মানব সৃষ্ট বিপর্যয় ? যদিওবা এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই হয়তোবা মনে করতে পারেন যাদের বিপর্যয় সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই তারাই ইে ধরনের প্রশ্নের অবতারনা করতে পারে । যাদের মনে এই ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে তাদের জন্যই আমার আজকের এই সামান্য লিখা। জানি এই লিখা পড়ে অনেকেই অসন্তুষ্ট হবেন , প্রশ্ন তুলবেন লিখার লেখকের যোগ্যতা নিয়ে । তবে যার মনে যাই থাকুক না কেন রাঙামাটির মাটির একজন সন্তান হিসাবে আমার সামান্য জ্ঞান দিয়ে বিচার বিশ্লেষন করেই আমার এই লিখার প্রচেষ্টা।

গত জুলাই মাসের শেষ হতে আগষ্ট মাসের সূচনা লগ্ন পর্যন্ত প্রথম দিকে আষাঢ়ের বর্ষন এবং পরে কোমেনার প্রভাবে রাঙামাটিতে যে বর্ষন হয়েছে তাতে রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকায় ব্যাক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পাশাপাশি সরকারী সম্পত্তিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । তবে রাঙামাটি বাসী অনেক ভাগ্যবান যে এই দূর্যোগময় পরিবেশে রাঙামাটিতে কোন প্রাণ হানির ঘটনা ঘটেনি। এর জন্য স্থানীয় জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, ফায়ার ব্রিগেড, পৌরসভা সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার। বিশেষ করে বারং বার মাইকিং করার পরেও শহরের বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে আসার পরেও যখন তারা ঝুঁকিপূর্ন স্থান ত্যাগ করেনি তখন রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের নেতৃত্বে একাধিক টিম পুলিশ, দমকল বাুিহনী ও পৌর ককর্তৃপক্ষের সদস্যদর সহায়তায় জোরপূর্বক তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনেন যে কারনে জীবনহানির ঘটনা রাঙামাটিতে ঘটেনি।

ফিরে আসি লেখার শিরোনামে , বর্ষনের কারনে সৃষ্ট দূর্যোগকে অবশ্যই প্রাকৃতিক দূর্যোগের সংজ্ঞায় পড়ে। তাই এই দূর্যোগকে সহজ সরল সমীকরনে প্রাকৃতিক দূর্যোগ বলা যায়। বর্ষনের কারনে সৃষ্ঠ এই প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে রাঙামাটি বাসী কম বেশী পরিচিত । কেননা মাঝে মধ্যেই তাদের এই দূর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। আর টানা কয়েকদিনের বর্ষনের পর রাঙামাটি জেলা তথ্য অফিসের মাইকে কখনো জেলা প্রশাসন আবার কখনো পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে করা সতর্কতা মূলক মাইকিং এর প্রচারনার সাথেও রাঙামাটি বাসী কমবেশী পরিচিত।

এবার আসি প্রাকৃতিক দূর্যোগ নাকি মানবসৃষ্ট দূর্যোগ ? এই প্রশ্নের উত্তরে। বর্ষন হবে সেটা হচ্ছে প্রকৃতির সহজাত নিয়ম । কখনো অল্প, কখনো স্বল্প, কখনো মাঝারী আবার কখনো ভারী বর্ষন এই সবকিছু হচ্ছে বর্ষনের বিভিন্ন মাত্রা । প্রকৃতির বর্ষন হবে এবং বর্ষনের পানি গড়িয়ে পড়বে কাপ্তাই হ্রদে । এটি স্বাভাবিক নিয়ম । কিন্তু যদি এই স্বাভাবিক নিয়মটির ব্যত্যয় ঘটে তখন সেটি হয় অস্বাভাবিক । আর এই ব্যত্যয়েে পিছনে যদি মানুষের কর্মকান্ড জড়িত থাকে তখন এই ঘটনাকে কি বলা যায়?

রাঙামাটির প্রবীন এবং প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞজনদের অভিমত বছর বিশেক আগেও রাঙ্গামাটিতে এই ধরনের প্রবল বর্ষনের পরেও রাঙামাটিতে এই ধরনের দূর্যোগময় পরিষ্থিতির সৃষ্ঠি হতো না। অতি বর্ষনের কারনে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার উপর পাহাড় ধ্বসে পড়ায় রাঙামাটির সাথে দেশের অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ন এলাকায় পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ছিল কদাচিৎ । এর কারন হিসাবে তাদের অভিমত ছিল সে সময় রাঙামাটি ছিল প্রকৃত অর্থেই পরিবেশ বান্ধব । রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত চমৎকার । যে কারনে বৃষ্টির পানি সহজেই অপসারিত হতো। অপর দিকে অধিকাংশ পাহাড়ের পাদদেশ ছিল নিরাপদ । কিন্তু এখন আর সেই পরিবেশ নেই। নিরাপদ এই সব প্রাকৃতিক পাহাড় গুলোর অস্তিত্ব এখন বিপন্ন ।

পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু পাহাড়ের মধ্য দেশে কিংবা পাদদেশে নির্বিচারে কাটা হয়েছে পাহাড়। গড়ে তোলা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ন পরিবেশের । বর্তমানে এইসব ঝুঁকিপূর্ন পাহাড়ী এলাকায় যারা বসবাস করছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগের অধিক নিঃস্ব ও দরিদ্র বলা যায়। এখন তাদের এখান থেকে যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। কিন্তু এইসব পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ন পরিবেশ সৃষ্ঠির পেছনে কাদের ইন্ধন রয়েছে কিংবা কারা লাভবান হয়েছে সে বিষয়টি একটু হলেও খতিয়ে দেখা দরকার। ঝুঁকিপূর্ন যে পাহাড়ের মদ্যে লোকজন বসবাস করছে সে সব পাহাড়ের কিছু ব্যক্তিগত মালিকানাধনি আবার কিছু সরকারী । অপর দিকে রাঙ্গামাটি শহরের অভ্যন্তরে পাহাড়ের পাদদেশে যাদের বসবাস সেসব জমির শতকরা ৯০ ভাগই খাস জমি যেহেতু বন্দোবস্তী প্রক্রিয়া বন্ধ আছে । আর এই সব ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা খাস জমি বিক্্িরর সাথে যারা জড়িত তারা সকলেই এখন ধরা ছোয়ার বাইরে । এইসব জায়গার মালিকানা একাধিকবার হাত বদল হয়েছে । পাহাড় কাটা নিষেধ হলেও সকলের চোখের সামনে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হয়েছে। কেউ বাঁধা দেয়নি। যখনি বাঁধা দেয়ার প্রশ্ন এসেছে তখনি উঠে এসেছে কখনো সাম্প্রদায়িকতার কথা, কখনো স্থানীয় কিংবা জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা আবারো কখনো প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কথা । ফলে যার যেমন খুশি তেমন ভাবেই পাহাড় কেটে জনবসতি গড়ে তোলা হয়েছে। যেগুলো এখন অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ন । অর্থ্যাৎ এখানকার প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে মানুষের কারনে।

পাশাপাশি দেখা যাক রাঙামাটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন এলাকার বিষয়ে। রাঙামাটির মাটির উপর ভিত্তি করেই এখানে সকল অবকাঠামো গড়ে উঠার কথা। এখানে কি ধরনের অবকাঠামো নির্মান পরিবেশ সম্মত এবং ঝুঁকিমুক্ত সে বিষয়ে প্রচলিত বিল্ডিং কোড রয়েছে। আর পৌরসভা এলাকায় নির্দিষ্ট ডিজাইন অনুমোদন সাপক্ষে বিল্ডিং নির্মানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু রাঙামাটি পৌরশহর এলাকায় অবকাঠামো নির্মানে এইসব নিয়ম কানুন কতটা পালন করা হচ্ছে তা সকলেরই জানা। অর্থাৎ এখানেই মানুষেরাই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজের খেয়াল খুশিমত অবকাঠামো নির্মান করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকে বিনষ্ট করছে।

রাঙামাটি শহরে পানি নিষ্কশনের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এখানকার অধিকাংশ ড্রেনেজ এর উপর এখন বিশাল বিশাল অট্টালিকা। অর্থ্যাৎ ড্রেনের জায়গা বন্ধ হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের সকল পথ অবরুদ্ধ । তাই এই সব পানি বের হয়ে আসার সূযোগ নেয়। যে সব পাহাড় দিয়ে এইসব পানি অপসারিত হবে সেসব পাহাড়ও এখন অট্টালিকার ভীড়ে হারিয়ে গেছে। তাই সামন্য বৃষ্টিতেই এখন এখানে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, রাঙামটি সরকারী মহিলা কলেজ এলাকা, রিজার্ভবাজার,তবলছড়ি, ভেদভেদী এলাকা সহ আরো অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে পাহাড় কেটেই বিশাল বিশাল অট্টালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে আর এই বার অতিবর্ষনে এই সব এলাকায় সর্বাধিক পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটেছে। মানুষের অতি লোভী মানসিকতাই এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী । প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হলে প্রকৃতি নিজেই তার প্রতিশোধ নেমে এই চিরসত্য আমাদের জানা থাকলেও কখনো ব্যক্তি স্বার্থে কিংবা কখনো তুচ্ছ স্বার্থে আমরাই প্রকৃতিকে আজ ধ্বংস করেছি। আর একৃতি এখন আমাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে । তাই প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়কে আমরাই এখন চরন বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে গেছি।

এতক্ষন বলেছি পানি নিষ্কাশনের অবস্থা নিয়ে। এবার দেখা যাক নিষ্কাশিত হয়ে যেখানে পানি যাবে সেই কাপ্তাই হ্রদের কি অবস্থা? পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে রাঙামাটি শহরের কাপ্তাই হ্রদ এর তীরবর্তী এলকা বলতে এখন আর কিছুই নেই। যতটুকু ডাঙ্গা সেখানেই ্ স্থাপনা। শুধূ তাই নয় যেখানের ডাঙ্গার সন্ধান নেই সেখানে আবার বিশেষ প্রক্রিয়ার ঝুলন্ত অবস্থায় স্থাপনা । আবার হ্রদ ভরাট করে রাঙামাটি পৌর ট্রাক টামিনাল কিংবা রাঙামাটি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নির্মান সব কিছুতেই কাপ্তাই হ্রদের স্বাভাবিক পরিবেশকে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা । অর্থ্যাৎ সরকারী পর্যায়েও কাপ্তাই হ্রদের স্বাভাবিক পরিবেশকে বিপন্ন করা হয়েছে।তাই পানি যাওয়ার আর রাস্তা নেই কাজেই পানির কাছেই সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার। আমাদের লোভী মন মানসকতার কাছে পাহাড়, হ্রদ সব কিছুই বিপন্ন।
তাই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের এখন থেকেই সজাগ হতে হবে যদিও এমনিতে অনেক দেরী হয়ে গেছে তথাপি চেষ্টা শুরু করতে হবে। আমাদের লোভী মন মানসিকতার কারনে এখানকার প্রকৃতি আর যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনকে হতে হবে কঠোর । ঝুঁকিপূর্ন পরিবেশ থেকে রাঙ্গামাটি বাসীকে কিভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে এখন থেকেই নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। নতুবা এমন দিন আসবে যখন পরিবর্তিত গানের ভাষায় বলতে আমার করার কিছুই ছিলনা । চেয়ে চেয়ে দেখলাম সব কিছুই শেষ হয়ে গেল । কাজেই সময় থাকতে সাবধান।

 
লেখক : রাঙামাটির একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

 

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 501 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen