শিরোনামঃ

নববর্ষের বিলম্বিত ভাবনা

পাহাড়ের রাজনীতি ও নেতাদের নীতি আর ধান্ধা বৃত্তান্ত : প্রদীপ চৌধুরী

বাংলা সনের হিসেবে নতুন বছর পা দিলো সপ্তাহখানেক হয়। বিদায় বছরের শেষ প্রান্তিক থেকেই পাহাড়ের রাজনীতিতে বেশ টানাপোড়েন চলছিলো। রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সার্কুলার, বাবুছড়ায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপনসহ Prodipনানামুখী দাবী-দাওয়ায় পাহাড়ের দুই প্রধান আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল মাঠে বেশ সক্রিয় ছিলো। বেশ কয়েকটি সামাজিক অপরাধের ঘটনাও ঘটেছে। সবকিছু মিলে আদৌ নববর্ষের সাথে পাহাড়িদের প্রাণের উৎসব ‘বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু (বৈসাবি)’ ভালোই ভালোই হবে কীনা? এমন শংসয় সামনে এসেছিলো।
কিন্তু সরকার, সরকারী দল, স্থানীয় মন্ত্রী-এমপি এবং প্রশাসনের আন্তরিকতায় পাহাড়ের বৈসাবি উৎসবের প্রাণোচ্ছ্বলতা ছড়িয়েছে থানছি থেকে তাইন্দং, দুধকছড়া থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি। একটি সুসংবাদ দিয়েই শুরু করি। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, এবারের বৈসাবি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি জেলার প্রয়াত ও জীবিত নয় গুণীজনকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ সন্মাননা প্রদান করেছে। নিঃসন্দেহে এটি ভবিষ্যত ইতিহাসের ধারাকে সমৃদ্ধ করবে। আলোকসঞ্চার করবে নতুন প্রজন্মের চোখে-মুখে ও মনে।
ঠিক বৈসাবি’র আনন্দ-উৎসবের মাঝেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে বৈসাবি উৎসবের জন্য পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য চারদিনের সরকারী ছুটি ঘোষণার সংবাদটি সচেতনমহলে দারুণ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করেছে। কিন্তু এতো বড়ো একটি সিদ্ধান্তকে পাহাড়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যেনো মামুলি হিসেবে নিয়েছে। তাঁদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে যথোপযুক্ত সন্মান প্রদর্শনের ভদ্রতাও পরিলক্ষিত হয়নি।
সে যাক বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার এবং ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতিতে বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটিয়েছে সরকার। তিন জেলার তিনটি ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’র নেতৃত্বের পরিবর্তনের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে কলেবরও। প্রথমবারের মতো তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদে আইনী সুরক্ষায় স্থান পেলেন দুইজন করে নারী প্রতিনিধি। এটিও পার্বত্যাঞ্চলের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুসংবাদ।
এখানকার রাজনৈতিক দুষণের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই জিম্মি হয়ে আছেন সাধারণ মানুষ। এখানকার নেতারা সাধারণ জনগণের কাছে সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ; কোনটাই পৌঁছে দেবার দায়বোধ করেননা। কারণ, তাঁরা এখানকার সাধারণ মানুষকে ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। কারণ যেকোন নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িকতার এই ধুয়া তুলে দেয়া গেলেই বাজিমাৎ।
রাজনীতির বহুমাত্রিক দুষণের কবলে পড়েছে এখানকার উৎসব-পার্বণও। বেশ কয়েক বছর ধরেই খাগড়াছড়ি জেলাশহরেই বৈসাবি উপলক্ষে কমপক্ষে ছয়টা শোভাযাত্রার আয়োজন করা হচ্ছে।

পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসনের আয়োজনকে রুটিনওয়ার্কের মতো লাগলেও চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বহুধাবিভক্ত শোভাযাত্রার নেপথ্যে ছিলো নানা কিসিমের রাজনীতি। আওয়ামীলীগ-বিএনপি, সংসদ-ঐক্য পরিষদ, গোত্রবিরোধ আরো কতো কী? তবে এতোসব শোভাযাত্রার মধ্যেও কী এক কারণে ‘সম্মিলিত বৈসাবি উদযাপন কমিটি’-র ব্যানারে আহুত এক শোভাযাত্রা প্রশাসনের বাধায় পন্ড হয়ে যায়। তবে সংগঠনটির বিরুদ্ধে অনিবন্ধিত আঞ্চলিক দল ‘ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’-এর সম্পৃক্ততার জোরালো অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এমনকি ঐ শোভাযাত্রায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশের ভাষায় ‘ওয়ান্টেড’ আসামীর হদিস মিলছিলো।
পন্ড হওয়া শোভাযাত্রাটিসহ বৈসাবির আধাডজন শোভাযাত্রার পেছনে সরকারী-বেসরকারী (চাঁদা) বিপুল পরিমাণ অর্থের ব্যয় হয়েছে। সরকারের টাকা যে, কতোরকম ভাবে অপব্যয় হয়; তা সাধারণ মানুষ কখনোই জানতে পারেনা। রীতিমতো টাকার বিনিময়ে শোভাযাত্রার কলেবর বৃদ্ধির জন্য ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ে লোক সংগ্রহে দালাল নিয়োগের খবরও পাওয়া গেছে। এ হলো, পাহাড়ে ধান্ধাবাজির নতুনরুপ।
বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দু’জনই ত্রিপুরা ছিলেন। সেসময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, এনডিসি। সেসময় ‘সান্তুআ জার্ণাল’ নামের অনিয়মিত এক সংকলনে রাজনীতিক শক্তিপদ ত্রিপুরার এক লেখায় দেখেছিলাম, নেতা বা ক্ষমতাবান মানুষের সংখ্যা বাড়লেই কোন জাতিগোষ্ঠির সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটেনা। যদি না ওইসব নেতা এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্বদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রতি উদার ভালোবাসা না থাকে। সেই লেখাতে লেখক রীতিমতো উস্মা প্রকাশ করেই উল্লেখ করেছেন, ‘ত্রিপুরারা কলা পায়’।
পাহাড়ে রাজনীতি অনেক আগে থেকেই ধান্ধাবাজি এবং সুবিধাবাদিতার একটি মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে আছে। যিনি বা যাঁরা খুব জোরের সাথে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা বলেন, বাস্তবে তাতে তাঁর বিশ্বাস একেবারেই অনুপস্থিত।
‘কী জাতীয়-কী আঞ্চলিক’- পাহাড়ের ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের সকলেই সমানতালে ফুলে-ফেঁপে বড়ো হতে চান, খুব দ্রুত। টাকার জোরে রাজনীতিতে (বিশেষ করে জাতীয়) তক্কে তক্কে ওপরে উঠা, ক্ষমতায় যাওয়া এবং যাওয়ার অল্পদিনের মাথায় নিজের ও চৌদ্ধ গোষ্ঠির ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যাওয়ার ইতিহাস পাহাড়ে একেবারে সাদামাটা নিরস গল্প। এমনকি বেশীরভাগ সময়, আমরা সংবাদকর্মীরাও এসব ভয়ালদৃশ্যে রস খুঁজে পাইনা।
মুলতঃ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং আয়কর বিভাগের শৈথিল্যের কারণে এখানকার ক্ষমতাবানরা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে চলেছেন অব্যাহত গতিতে
পেশীশক্তি-লেজুড়তোষণ, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য আর সৎ-ত্যাগী নেতাদের উৎখাত করার মধ্য দিয়ে চলেছে পাহাড়ের আড়াই দশকের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা। এটি কোনভাবেই সারাদেশের মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলা যাবেনা। কারণ এখানে অতীতের মতো ক্ষমতাসীন ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো সমানভাবে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করতে উদ্যত থাকে। হয়তো দীর্ঘদিন যুদ্ধাবস্থা থাকার কারণেই এমন পরিবেশ দৃশ্যমান এখনো। এই কারণেই পাহাড়ের জাতীয় রাজনীতির নেতারা হন, সরকারমুখী আর আঞ্চলিক নেতারা হন, পেশীশক্তিমুখী। তাঁরা খুব বেশী সাধারণ মানুষের কাছে যানও, আবার যেতেও হয়না। শুধুমাত্র ভোট বৈতরণী পাড়িতেই যেটুক যেতে হয় বাধ্য হয়ে। এসব কারণে পাহাড়ের রাজনীতিতে খুব বেশী লোক নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে পারেননি। অনেকের নাম ভুলে গেছেন সতীর্থ আর সাধারণ মানুষ, আবার অনেকের নাম হারিয়ে গেছে নিজ দলের সর্বশেষ স্থান থেকেও।

দক্ষিণের বীর বাহাদুর, মধ্যিখানের গৌতম দেওয়ান ও দীপংকর তালুকদার এবং উত্তরের ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও প্রসীত খীসারা, রাজনীতির শুরু থেকে আজতক টিকে আছেন বেশ দাপটেই। এটির একটি বড়ো কারণ তাঁরা ছাত্ররাজনীতির ফসল। আবার এই নামগুলোর বাইরে অনেকে ছাত্র রাজনীতির দক্ষ হাতিয়ার কিংবা নেতা হবার পরও খেই হারিয়েছেন রাজনীতির মাঠে, নেতৃত্বের মাঠে-প্রতিযোগিতায়, জনসমর্থন সংকট আর অদক্ষতায়। তার বিপরীতে সম্পূর্ন ব্যক্তিগত যোগ্যতায় চরাই-উৎরাই পেরিয়ে অনেকে একেবারে উঠে এসেছেন শীর্ষপদে।

রাঙামাটির উষাতন তালুকদার, খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কংজরী চৌধুরী ও রফিকুল আলম। এর বাইরে খাগড়াছড়ি তথা পার্বত্যাঞ্চলের কৃতী সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা এখন পর্যন্ত রাজনীতির বাইরে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে আসতেও পারেন বলে আভাষ মিলছে। মেধা আর যোগ্যতায় বহুমাত্রিক এই মানুষটি এরিমধ্যে পার্বত্যাঞ্চলের প্রথম ব্যক্তিত্ব হিসেবে ‘সচিব’-এর পদ অলংকৃত করেছেন। এর আগে ছিলেন পুলিশের দ্বিতীয় শীর্ষ প্রধান।
পাহাড়ের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলের নেতাকর্মীর তুলনায় জাতীয় রাজনীতির নেতাকর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একেবারেই অপ্রতুল। যদি খাগড়াছড়ি জেলার আওয়ামীলীগ বিএনপি’র জেলা পর্যায়ের নেতাদের পাল্লাই তোলা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ চুকিয়েয়েছেন এমন নেতার সংখ্যায় ডজন পুরণ কঠিন হবে।
এমন দৃশ্য রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারপও রাজনীতির জন্য আহামরি লেখাপড়ার প্রয়োজন নাও পড়তে পারে। কিন্তু জনগণের মনে আশা জাগানো, ভরসার ভিত্তি রচনা, সরকারের সদিচ্ছাকে জনমানসে পৌঁছে দেয়া; এসব রাজনীতি আর নেতাদেরই কাজ। শুধুমাত্র অর্থে-বিত্তে রাতারাতি মোটাতাজা হবার চিন্তা তো জনগণকে সরকারবিমুখ যেমন করবে তেমনি চিরস্থায়ী ভাবে যেকোন দল বা দলের নেতাকেও পৃষ্ঠ প্রদর্শনের ঘটনা ঘটতে পারে।
খুব নিকট অতীতে এসব জ্বলন্ত ইতিহাসের উত্তাপ পাওয়া যায়। নতুন বছরে সবকিছু ছাপিয়ে একটিই কামনা, ‘পাহাড়ের রাজনীতি ও নেতারা হয়ে উঠক, সাধারণ মানুষের’।

 

প্রদীপ চৌধুরীঃ পাহাড়ের সংবাদকর্মী।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 726 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen