শিরোনামঃ

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ‘প্রতিষ্ঠা’ নিয়ে বিভ্রান্তি ও কিছু কথা : শান্তিদেব চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর সংগঠনগুলোর মধ্যে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) অন্যতম একটি সংগঠন। পুরনো সংগঠন হলেও “৪১তম” প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর (২০১৩) আগে বা পরে সমিতিকে PCJSSকখনই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করতে দেখা যায়নি। জনসংহতি সমিতি-শান্তিবাহিনী গোপন রাজনীতিতে থাকার সময়ও প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের কথা জানা যায় না।
সত্যি বলতে কী, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা আসলে ঠিক কবে হয়েছে, এ নিয়ে এতকাল সাধারণ মানুষের মাঝে বিশেষত রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের কাছে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি ছিল। ২০১৩ সালে “১৫ ফেব্রুয়ারি” ৪১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে ৫২জন কর্মী-সমর্থকের অপহৃত হবার ঘটনায় জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে মানুষের কৌতুহল পুনজাগ্রত হয়েছে। এই ৪১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতি “১৫ ফেব্রুয়ারি”-কে প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ধার্য করেছে, তা স্পষ্ট হলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা যারা খবরা খবর রাখি, তারা কমবেশি সবাই এটা জানি যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধি দল ৪দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি দিয়েছিল। অফিশিয়ালি উক্ত প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন মং সার্কেল চিফ রাজা মং প্রু সাইন (মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল পদবী প্রাপ্ত), মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ছিলেন একজন সদস্য। এটা অমূলক নয় যে, অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা হিসেবে প্রতিনিধি দলটি সংগঠিত করতে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকবেন। অনেক কাগজপত্রে মানবেন্দ্র লারমাকে উক্ত প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা তথ্যগতভাবে ঠিক নয়। এমন আরও অনেক ভুল তথ্য আছে, যা খতিয়ে দেখার সামান্য কষ্টটুকুও স্বীকার না করে একশ্রেণীর গবেষক-সাংবাদিক-লেখক-সামরিক কর্মকর্তা-আমলা অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক ও পাইকারিভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন করে যাচ্ছেন এবং মনগড়া বিশ্লেষণও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্রয় দিয়ে ভুল তথ্য জিইয়ে রাখায় কী ক্ষতি হচ্ছে, তা কতটা গুরুতর পরিণাম বয়ে আনছে– সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে, লক্ষ্যমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু সেটি নয়।

আলোচ্য নিবন্ধের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ-স্থান সম্পর্কে সত্য উদঘাটন করে বিভ্রান্তি দূরীকরণ, যাতে অন্যদের নিকট আমাদের নানা প্রশ্ন ও উপহাসের পাত্র হতে না হয়, আর পাহাড়ের সাধারণ মানুষও যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হয়। ১৯৭২ সালের “১৫ ফেব্রুয়ারি”– প্রতিষ্ঠা ধরে নিয়ে ২০১৩ সালে রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ) অনেকটা ঘটা করে “৪১তম” প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করেছিল। ১৯৭২ সালের ঐ দিন ঢাকায় শেখ মুজিবের কাছে ৪দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল, আর উক্ত দলে ছিলেন খোদ জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাও। খট্কা লাগার বিষয়টি এই, একই দিনে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নিকট “স্মারকলিপি প্রদান” আর রাঙামাটিতে “জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা” কিভাবে সম্ভব? ’৭২ সালে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মত এমন উন্নত ছিল না যে, চার্টেড হেলিকপ্টার দিয়ে ঢাকা থেকে রাঙামাটি গিয়ে প্রোগ্রাম করা যাবে, যদি তা করাও যেত, তাহলেও কি একই দিন প্রধানমন্ত্রীর নিকট “স্মারকলিপি পেশ” আর একটি “সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সভা আয়োজন” সম্ভব হতে পারে…?
সাধারণজ্ঞান থেকে যে কারও মনে এ প্রশ্ন উদয় হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার যে, এমন একটি বিষয় যা সাদা চোখেও দৃশ্যমান, এ পর্যন্ত তা নিয়ে কোন প্রকাশ্য আলোচনা বা লেখালেখি হয়নি। আজকাল কত সভা-সেমিনার হয়, জ্ঞানগর্ভ কত আলোচনাই চলে, অথচ এই ব্যাপারে যে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে না, মৌনব্রত পালিত হচ্ছে, সেটাই ভাববার বিষয় এবং অস্বস্তিকরও বটে!
বিষয়টি আঁতকে ওঠার মত গুরুতর এ কারণে যে, জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ)-এর কাল্পনিক ৪১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে যোগ দিতে দেশের রাজনৈতিক দলের একশ্রেণীর নেতা ও শিক্ষকসহ বেশ কয়েক জন তাতে অংশ নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকের ব্যাপারে নানা কথা আছে! গল্পের সেই অনুগত পারিষদের মত ‘ন্যাংটো রাজার পেছনে ঘুরে বেড়ানো’র কারণে এরা দেশের সাধারণ মানুষের নিকট বিতর্কিত (পাহাড়েও এদের ব্যাপারে রসিকতা হয়)। গল্পের বাচ্চা ছেলেটির মত সত্য উচ্চারণের মুরোদ যাদের নেই, তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে ও তা জিইয়ে রাখতে পারে মাত্র, মোচন করতে পারে না।
১৯৭২ সালের ঐ দিন বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি দল প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, স্মারকলিপিটিও গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো প্রতিনিধি দলকে “বাঙালি” হয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে কারণে “১৫ ফেব্রুয়ারি” সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি দলকে অসম্মান তথা সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহকে অবমাননার প্রতিবাদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, সত্যের খাতিরে সেটাই হওয়া উচিত। ৩০ জুন ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী আইন প্রবর্তন করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সকল জাতিসত্তার ওপর পুনরায় “বাঙালি জাতীয়তা” চাপিয়ে দিয়েছে, এক অর্থে বলা যায় যার সূচনা হয়েছে ১৯৭২-এর “১৫ ফেব্রুয়ারি”তে। এমন একটি গ্লানিময় দিবসকে জনসংহতি সমিতি (সন্তুগ্রুপ) নিজেদের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করেছে, তা বিস্মিত না করে পারে না। জনসংহতি সমিতি (লারমাগ্রুপ) এখনও এই দিবসটি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী হিসেবে পালন করে নি। তাদের দিক থেকে প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ঘোষণা দিয়ে কোন একদিন নিশ্চয়ই তারা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি দূর করতে উদ্যোগী হবেন। কারণ যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে একটি সংগঠন চলছে, সে ব্যাপারে বিভ্রান্তি জিইয়ে থাকা উক্ত সংগঠনের জন্যও মঙ্গলজনক নয়।

শান্তিদেব চাকমা, কেন্দ্রীয় নেতা, ইউপিডিএফ

লেখাটি লেখকের একান্ত ব্যাক্তিগত।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 1,139 বার পঠিত হয়েছে


Subscribe to Comments RSS Feed in this post

One Response

  1. Pingback: Brajendu Chakma

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen