ফজলুর রহমান রাজন, সিএইচটি টুডে ডট কম , রাঙামাটি। রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিন জেলায় উপজাতীয়দের বিপুল সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পূঁজি বিনিয়োগ, পৃষ্টপোষকতা, শিল্প সহায়তা, বাজারজাত ও উদ্যোক্তার অভাবসহ নানা সংকটের কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প ব্যাপকহারে প্রসারিত হতে পারছেনা। উন্নয়ন ও সংস্কারের অভাবে এসব শিল্প সামগ্রির উৎপাদন বাড়ছে না।
অন্যদিকে সরকারী সহায়তার অভাব এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশে-বিদেশে ব্যাপক কদর পেয়েও হারিয়ে যেতে বসেছে তাত শিল্প। আর্থিক দৈন্যতা ও সুতার দাম বৃদ্ধি শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় রাঙামাটির অধিকাংশ তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত কারখানা বন্ধের পথে। এছাড়া কম দামে বাহিরের কাপড় রাঙামাটির মার্কেট দখল করায় তাতের কাপড়ের কদর কমে গেছে। কেবল রাঙামাটিতে বাহির থেকে বেড়াতে আসা লোকজনই তাঁত কাপড় কিনছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সংখ্যা গরিষ্ট জনগোষ্ঠির জীবিকার মূল উৎস কৃষি, ফলের বাগান, বনজ সম্পদ ও মৎস্য আহরণ ইত্যাদি। অথচ নানা কারণে এসমস্ত পেশায় রয়েছে অনেক ধরণের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠার সম্ভাবনা থাকলেও তা-সঠিক অর্থে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আজ থেকে ২৩ বছর আগে মানিকছড়িতে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের কাজ হাতে নিলেও এটি অজ্ঞাত কারনে মূখ থুবড়ে পড়ে আছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙ্গালীর জনজীবনে বিদ্যমান রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ি জনগোষ্ঠির লোকজন যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকায়। এ কারণে তাদের গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র জীবনধারা। বিশেষত: আবাস গৃহ, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যভ্যাস, ব্যবহারিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমতলবাসী থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠিরাও আবার সবাই এক রকম নয়। তাদের মাঝেও রয়েছে বৈচিত্রতা, ভিন্ন জীবনধারা, পৃথক ভাষা, পোষাক- পরিচ্ছদ, খাদ্যভ্যাস, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি। আর এই ভিন্নধারার জনগোষ্ঠি পরিচিত পৃথক পৃথক নামে। যেমন- চাকমা, মারমা বা মগ, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, বম, মুরং, খিয়াং, চাক, খুমি ইত্যাদি। প্রত্যেক জনগোষ্ঠির জীবনধারা ও সংস্কৃতি ভিন্নতর। সাধারণত: এই জীবন বৈচিত্র্যের পটভূমিতেই গড়ে উঠেছে এখানকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প । পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠিদের মধ্যে দেশের অন্যান্য এলাকায় প্রচলিত কুটির শিল্প গড়ে ওঠেনি। তাদের গ্রামাঞ্চালে প্রায় প্রতিটি ঘরে দু’রকম শিল্পের প্রচলন দেখা যায়। যেমন- মেয়েরা কোমর তাঁত বা বেইনে এবং পুরুষরা বাঁশ-বেতের নানা প্রকার ব্যবহারিক সামগ্রী তৈরী করে।
পাহাড়ি মেয়েদের বস্ত্রশিল্প : কোমর তাঁতে কাপড় তৈরী করা পাহাড়ি মেয়েদের ঐতিহ্যগত শৈল্পিক কাজ। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন সাজের জাতীয় পোষাক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। পাহাড়ি মেয়েরা কোমর তাঁতে বুনে এসব পোষাক তৈরী করে। আবার এক জাতিগোষ্ঠির পোষাকের সাথে অন্য জাতিগোষ্ঠির পোষাকের মিল নেই। কে কোন সম্প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত তা মেয়েদের পোষাক দেখেই চেনা যায়। অতীতে এক সম্প্রদায়ের কাপড় অন্য সম্প্রদায়ের কেউ তৈরী করতনা। এজন্য তখন তাদের কোন পোষাক বাজারে পাওয়া যেতনা। যার যার কাপড় তাদের নিজেদেরই তৈরী করতে হতো। তাই কাপড় বুনা পাহাড়ি মেয়েদের জন্য অত্যাবশকীয় ছিল। পরিবারের সবার জন্য সারা বছরের ব্যবহার্য কাপড় মেয়েদের তৈরী করতে হত। মেয়েদের জন্য পিনন, খাদি, পুরুষদের ধুতি, গামছা,শীতকালে ব্যবহারের জন্য বর্গী বা চাদর, মাথায় পরার জন্য খবং বা পাগড়ি কোমর তাঁতেই তৈরী করতো মেয়েরা।
তখনকার সময়ে আজকের মতো মিলের তৈরী সূতা বাজারে পাওয়া যেত না। জুমে উৎপাদিত তুলা থেকে চরকায় সূতা কেটে সেগুলি সূতা রং করে কাপড় বুনতে হত। রং করার জন্য ব্যবহৃত হত বিভিন্ন গাছের ফুল,ফল, পাতা কিংবা গাছের ছালের রস। এসব ভেষজ উপকরণ ব্যবহার করেই সূতায় মাখানো হতো নানা রং। পাহাড়িদের সমাজে প্রত্যেক পরিবারেই কোমর তাঁত বা বেইন শিল্পের প্রচলন ছিল ব্যাপক ও অপরিহার্য। কাপড় বুনার জন্য মেয়েদের সংগৃহীত থাকতো বিভিন্ন নক্শা সম্বলিত ক্যাটালগ বা আলাম। ভাল ভাল নক্শা দিয়ে সুন্দর সুন্দর কাপড় বুনা মেয়েদের বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত হতো। বিবাহের ক্ষেত্রেও ভাল কাপড় বুনতে জানা পাত্রীর যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হতো।
বেইন শিল্পের প্রসার : অতীতে বেইন শিল্প শুধু পরিবারের লোকজনের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হত। কিন্তু ষাট দশকের দিকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু হওয়ার পর এখানকার মানুষের কৃষি নির্ভর অর্থনৈতিক জীবন যখন অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন জীবিকার তাগিদে শুরু হয় বেইনের মাধ্যমে উৎপাদিত কাপড় বিপনন। এসব উৎপাদিত পোষাক সামগ্রি স্থানীয় পর্যায় ছেড়ে দূর থেকে আসা পর্যটকদের কাছেও ব্যাপক হারে কদর বাড়ে। এভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়ে পাহাড়িদের কুটির শিল্প সামগ্রির। বাড়ে চাহিদাও। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে চাহিদা বাড়লেও অদ্য অবধি এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি।
পাহাড়িদের বস্ত্র শিল্পের অন্যতম রূপকার হলেন প্রয়াত পঞ্চলতা খীসা। তিনি বর্তমানে বহুল পরিচিত রাঙামাটির বেইন টেক্সটাইলের মালিক মঞ্জুলিকা চাকমার মা। মায়ের কাছ থেকে শিখে মঞ্জুলিকা চাকমা ‘বেইন টেক্সটাইল’ স্থাপন করেছিলেন। এছাড়াও প্রয়াত বাসন্তী দেওয়ান, শরৎমালা চাকমা এবং নানিয়ারচরের মিনতি দেওয়ানের নাম উল্লেখযোগ্য। তারা উন্নত নক্শা ও কাপড়ের মান বৃদ্ধির কাজে সহায়তা করেছিলেন। উল্লেখ্য- পঞ্চলতা খীসা, প্রয়াত বাসন্তী দেওয়ান ও শরৎমালা চাকমা ঢাকা, করাচী ও লন্ডনে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য মেলায় বেইন বুনার কৌশল প্রদর্শন করে বেইন শিল্পকে সুপরিচিত করেছিলেন। একজন সফল নারী শিল্প উদ্যোক্তা মিসেস মঞ্জুলিকা চাকমা তার জীবন শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করেছিলেন,পরে মায়ের কাছ তাঁত শিল্প শিখে যখন লাভের মূখ দেখলেন তখন থেকে এ কাজ শুরু করেন। মঞ্জুলিকা চাকমা উপজাতীয় মহিলাদের মধ্যে একজন সফল শিল্প উদ্যেক্তা। তিনি এ শিল্প প্রচার ও প্রসারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশী-বিদেশী আর্ন্তজাতিক পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমান এ শিল্পের অবস্থান,সমস্যাসহ নানা বিষয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, শুরুতে ২ জন মহিলাকে নিয়ে নানা প্রতিকুলের মধ্যে ১৯৬০ সনে তাত শিল্পের কাজ শুরু করেন তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২ শত নারী-পুরুষ শ্রমিক ছিল এখন সেটি চার ভাগের একভাগে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলায় তার শো রুম রয়েছে। সর্বশেষ ঢাকায় শো করলেও মার্কেটের যা অবস্থা কয়দিন চলবে তা ঠিক বলতে পারছেন না। তিনি আরো বলেন,তার কাপড় ইতিমধ্যে বায়ারের মাধ্যমে নিউর্য়ক, পোলেন্ড, ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মান এবং অষ্ট্রেলিয়ায় রফতানি করেছেন। সরকার যদি এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা করত তাহলে এর পরিচিতি আরো বাড়ত। বর্তমানে রাঙামাটি শহরে বেইন টেক্সটাইলের দেখাদেখি নকশি,বনানী, বনলতা, বয়ন,রাখাইন এবং তন্তুজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে।
সরকারি উদ্যোগ ফলপ্র“স নয় ঃ পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিকাশ ও প্রসারে ১৯৯০ সনে প্রায় ৩ কোটি ২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের কাজ হাতে নিলেও গত ২৩ বছরেও এটি আলোর মূখ দেখেনি। ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা কাটিয়ে জেলা সদরের মানিকছড়িতে ১২.৫ একর জমি ২৮ লাখ টাকার বিনিময়ে জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহন করা হলেও বিভিন্ন সমস্যা ও উদ্যোক্তাদের অবহেলার কারনে এর কাজ চলছে মন্থর গতিতে। ১৯৯০ সালে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের পরিকল্পনা নিলেও স্থান নির্ধারনে সময় লেগেছে ৮ বছর,মাটি ভরাট কাজ শুরু হয়েছে ৫ বছর আগে যা এখনো চলছে আর কত বছর লাগবে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের কাজ শেষ করতে এ প্রশ্ন এখন এলাকাবাসীর।
তবে যারা প্লট নিয়েছেন তারা জানান, নিরাপত্তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে প্লট নির্মান কাজ করতে পারছে না। এতদুরে পরিবহন খরচে তারা পোষাতে পারবে না।
বিষয়টি নিয়ে প্রকল্পের ষ্টেট কর্মকর্তা আব্দুল মতিন জানান, ২০০৮ সন থেকে এপর্যন্ত ২৯টি শিল্প ইউনিটের বিপরীতে ৫৯টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারনে কেউ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজ হাতে নিচ্ছে না। তবুও আমরা চেষ্টা করছি।
এদিকে,পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত পণ্য সামগ্রি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রসার বিস্তারের জন্য ২০০৩ সাল থেকে যে পার্বত্য বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা হয়েছে- সেটিও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০০৩ সালে রাঙামাটিতে, ২০০৪ সালে বান্দরবানে এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পার্বত্য বাণিজ্য মেলা। এর পর আর মেলা হয়নি। গত ২/৩ বছর যাবৎ রাঙামাটিতে শিল্প উদ্যোক্ত মেলা হলেও সেটি ফলদায়ক কোন ভুমিকা রাখছে না। হাতে গোনা কিছু উদ্যেক্তা ছাড়াা এর সুফল কেউ পাচ্ছে না।
রাঙামাটির দারিদ্রপীড়িত এলাকাবাসী মনে করছেন বিসিক শিল্প নগরী স্থাপিত হলে পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বেকারত্বদূরীকরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত।