শিরোনামঃ

তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং আওয়ামীলীগের গাত্রদাহ : ওয়াদুদ ভূইয়া

বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই এর রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে করা হয়েছে অগণিত মিথ্যাচার। মুক্ত তথ্য প্রবাহের এই যুগে প্রতিটি পদে পদে বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত এই দেশের প্রতি জিয়াউর রহমান তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র অবদানকে মুছে দিতে তথ্য সন্ত্রাস চালিয়েছে একটি দল। wadudcopyইতিহাস বিকৃতি, জিয়ার অবদান মুছে ফেলা, ইতিহাসের বিকৃত সংস্করণ সৃষ্টি, জাতীয় বীরদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, বিভিন্ন মিমাংসিত বিষয় নিয়ে একের পর এক অপব্যাখ্যা, নিজেদের মতো করে ইতিহাস রচনা, নিরপেক্ষতাবোধ থেকে অনেক দূর সরে যাওয়া, সর্বোপরি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম বিষয় মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে রেখেছে যে দলটি, সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় আর তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করলে মুক্তিযোদ্ধাকে বানিয়ে ফেলা হয় রাজাকার। তার সাম্প্রতিকতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এ.কে খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বস্তুনিষ্ট বাস্তব সত্য প্রকাশ করায় তাকে রাজাকার ও আইএসআই’র চর বলতেও দ্বিধা করেনি আওয়ামী নেতারা। অথচ এ.কে খন্দকার তাদের গত সরকারেও মন্ত্রী ছিলেন। সাম্প্রতিক কিংবা ঐতিহাসিক, প্রতিটি প্রেক্ষাপট বিকৃত করে প্রচার করতে তাদের জুড়ি নেই। সে সমস্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং শহীদ জিয়া পুত্র তারেক রহমান। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে চাপা পড়া অনেক বিষয় তুলে এনে যুক্তিতর্ক দিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন, যেটি অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারেক রহমানের সেসব যুক্তি জাতির ভালোভাবে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করার এখনই সময়। তিনি ইতিহাসের কিছু বাস্তব ও কঠিন সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছেন। আওয়ামী প্রোপাগান্ডা মেশিন সবসময় যে জিনিসটি করে থাকে, সেটি হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততা প্রমানের ব্যর্থ চেষ্টা চালানো। এই অবৈধ সরকারের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী বহুবার বলেছেন, শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী অর্থাৎ বেনিফেসিয়ারি নাকি জিয়াউর রহমান। তাঁর যুক্তি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবাদেই সেনাপ্রধান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান! অথচ জিয়াউর রহমান যে বহু চড়াই উতরাই পার করে ইতিহাসের এক বাস্তবতায় জনগণের কান্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এই জিনিসটি শেখ হাসিনা সবসময় এড়িয়ে যান। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের বেনিফিসিয়ারি কারা, এ সম্পর্কে তারেক জিয়া বলেছেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। মোশতাক গঠন করেন মন্ত্রীসভা। শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার প্রায় সকলেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় শপথ নেন। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের এক নম্বর বেনিফিসিয়ারি স্বয়ং আওয়ামী লীগই। ঘটনার আবর্তে মনে হচ্ছিল, এখানে বাকশালের বিপক্ষে মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই যেন অবস্থান নিয়েছিল। এমনকি সেই মন্ত্রীসভা কিংবা শপথ অনুষ্ঠানে আনন্দের সাথে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকেই আওয়ামী নেতৃত্বাধীন গত ও বর্তমান অবৈধ সরকারের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পরপরই অর্থাৎ ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাকই সারাদেশে সামরিক আইন জারি করেন। ঐ সময় সেনাপ্রধান ছিলেন শফিউল্লাহ। শহীদ জিয়া সেই সময় ছিলেন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ। এখানেও আওয়ামী লীগের একটি প্রচারণার জবাব রয়েছে। আওয়ামী অপপ্রচারযন্ত্র দাবি করে, জিয়াউর রহমান নাকি দেশে সেনাশাসন জারি করেছিলেন। মোটেই তা নয়। বরং খন্দকার মোশতাকই দেশে সেনাশাসন জারি করে গিয়েছিলেন। এমনকি শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পরে মোশতাকের মন্ত্রীসভার শপথ অনুষ্ঠানেও যাননি জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের যদি ন্যুনতম সম্পৃক্ততা থাকতো, তাহলে তিনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে যেতেন। অথচ সেদিন বিজয়ীর বেশে সে শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছিল তাহের-ইনু বাহিনী, বর্তমান সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন নেতা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ সহ তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতারা। এমনকি তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা মালেক উকিল শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বলেছিল, জাতি আজ ফেরাউন-মুক্ত হলো। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও সেদিন বিদেশী মিডিয়ায় হত্যাকাণ্ডের স্বপক্ষে অনেক বক্তব্য রেখেছিল। সেসবের প্রমাণ এখনও আছে। শেখ মুজিবকে মৃত্যুর পরও নগ্নভাবে আক্রমন করেছিল ইনু। সেদিনকার সেই ইনুই আজকের অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত খাস লোক, এমনকি দুইবার তিনি তথ্যমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করেছেন! ইনুর গুরু কর্নেল তাহের মুজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সাথে বঙ্গভবনে গিয়ে দেখাও করে এসেছিল। এমনকি শেখ মুজিবকে কবর না দিয়ে সমূদ্রে ফেলে দেয়া উচিৎ ছিল বলে মত দিয়েছিল জাসদের সেই কর্নেল তাহের। সম্প্রতি সেসব তথ্যই উঠে এসেছে সাবেক এক জাসদ নেতা মহিউদ্দীন আহমেদের বইয়ে। সেই বইয়ে প্রদত্ত তথ্যকে উদ্ধৃত করে তারেক রহমান বলেছেন, শেখ মুজিব যেদিন নিহত হন, অর্থাৎ ১৫ আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা ছিল তাঁর। কর্নেল তাহেরের ছোটভাই, তৎকালীন ঢাকা নগর গণবাহিনীর প্রধান ও বর্তমানে আওয়ামী পদলেহনকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আগমন বাঁধাগ্রস্থ করতে বোমা বিস্ফোরন করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া এক সেনা কর্মকর্তা তখনও কেন সামরিক আইন ঘোষণা করতে পারলো না, সেজন্য তাকে তিরস্কার পর্যন্ত করেছিলেন কর্নেল তাহের। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা যারা করেছে, তাদের সাথে জড়িত থাকার ও প্লট সৃষ্টি করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এই জাসদ তথা গণবাহিনীর। কর্নেল তাহের সেদিন সেই সেনা কর্মকর্তার কাছে বেশ গর্বের সাথে দাবি করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ আগস্ট যারা বোমা বিস্ফোরণ করেছিল, তারা তার দলের সদস্য ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি হত্যা যারা করেছিলো, তাদের চেয়েও বড় অপকর্ম সুযোগ পেলেই এই জাসদ করতো, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ সম্ভাবনা অনুধাবন করে শেখ মুজিবুর রহমান তিনটি ট্যাংক নামিয়েছিলেন এই জাসদের বিরুদ্ধে – এই তথ্যই দিয়েছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি। পরবর্তীতে খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিল কর্নেল তাহের, তার তৎকালীন সহযোগী ও বর্তমান অবৈধ সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং আরেক বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। শুধু তা-ই নয়, মুজিব-বিরোধী আরেক জাসদ নেতা শাহজাহান খান আজ এই সরকারের মন্ত্রীসভায় আছে। মুজিবের চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজানোর ইচ্ছা পোষণ করা মতিয়া চৌধুরী আজ এ সরকারের কৃষিমন্ত্রী। একই সঙ্গে মোশতাক সরকারের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি এইচটি ইমাম আজ শেখ হাসিনার মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা। মানুষ ক্ষমতার জন্য কতটুকু পাগল হলে, নিজের সমস্ত পরিবারের হত্যাকারী কিংবা হত্যার প্লট সৃষ্টিকারী অথবা সে হত্যায় উল্লাস প্রকাশকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সহাবস্থান করতে পারে? ক্ষমতার জন্য কতটুকু উন্মাদ হলে মানুষ ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে নিজের পিতা-মাতা ও পরিবারের সকল সদস্যদের হত্যাকারী কিংবা হত্যায় সমর্থনকারীদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে? অথচ শেখ হাসিনার রাজনীতির ভিত্তিই হচ্ছে ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ এবং সে ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহকে পুঁজি করেই তিনি এখন পর্যন্ত ফায়দা নিচ্ছেন। তিনি ১৫ আগস্টের কথা বলতে বলতে কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করেন, কিন্তু নিজের পাশে রেখেছেন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সহযোগী শক্তিকে।

শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর আরো কমপক্ষে দশ দিন,অর্থাৎ ২৪শে আগস্ট পর্যন্ত জেনারেল শফিউল্লাহই ছিলেন সেনাপ্রধান। রাষ্ট্রদূত হিসেবে মোশতাকেরই অধীনে সরকারি চাকুরী কনফার্ম করার পর সেনাপ্রধানের পদ ছাড়েন শফিউল্লাহ। এরপর সেনাবাহিনীর বিধি অনুযায়ী যথানিয়মে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ থেকে প্রমোশন পেয়ে ২৫ শে আগস্ট সেনাপ্রধান হন জিয়াউর রহমান। তখন সেনাপ্রধানের পর সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন জিয়া। সঙ্গত কারণে, শফিউল্লাহ অবসর নেয়ার পর তিনিই হবেন সেনাপ্রধান, এটাই স্বাভাবিক রেওয়াজ। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রচারটি অনেকটা এমন যে, জিয়াউর রহমান যেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফিসিয়ারি হিসেবে গায়ের জোরেই সেনাপ্রধান হয়েছেন। অথচ কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর জ্যোষ্ঠতার নীতিতেই সেনাপ্রধান হয়েছিলেন তিনি। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর রক্ষীবাহিনীর প্রভাবমুক্ত একটি শক্তিশালী পেশাদার সেনাবাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন শহীদ জিয়া। কিন্তু ক্ষমতার মোহে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ভেতরে ভেতরে জিয়াউর রহমানকে সরানোর চক্রান্ত শুরু করেন। চক্রান্তের অংশ হিসেবে খালেদ মোশারফ ১৯৭৫ সালের ২রা নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোশতাকের অনুমোদন নিয়ে মেজর জেনারেল হিসেবে নিজেই নিজের প্রমোশন নেন ও সেনাপ্রধান বনে যান। এরপর প্রশাসন চলে খালেদ মোশারফের ইশারায়। ১৯৭৫ সালের ৫ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন মোশতাক। তার আগে মোশতাক এবং সেনাপ্রধান খালেদ মোশারফ বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেন ৬ই নভেম্বর। বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি। পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফেরার দুই দিন পর ১২ জানুয়ারী সায়েমকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে কিছু কথা উল্লেখ না করলেই নয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে যে ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়ে মুজিব কতৃক স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি করে আওয়ামী লীগ, সে ভাষণেই শেখ মুজিব বক্তব্য শেষ করেছিলেন ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলে। ৭ মার্চের ভাষণে যদি শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়েই থাকেন, তাহলে তিনি তাঁর বক্তব্য ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলে শেষ করেছিলেন কেন? যে বক্তব্যে পাকিস্তানের জয় কামনা করা হয়েছে, সেখানে কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিহিত থাকতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক ও আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক মন্ত্রী এ.কে খন্দকার, সাবেক প্রধান বিচারপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী হাবিবুর রহমান, প্রখ্যাত বামপন্থী লেখক আহমদ ছফা সহ আরও বহু লেখকের বইয়ে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলা বিষয়ক তথ্যের উল্লেখ আছে। তারাও মনে করেন না, শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে কোনো প্রস্তুতি ছিল। এদিকে মোশতাক-শফিউল্লাহর জারি করা সামরিক আইন বহাল থাকায় রাষ্ট্রপতি সায়েম একাধারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকেরও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলের মধ্যে সংঘটিত হয় ৪ নেতা হত্যাকাণ্ড। তখন জিয়াউর রহমান জেলে বন্দি। আবার ৬ নভেম্বর পাল্টা ক্যু’তে নিহত হন খালেদ মোশারফ। তখনও জিয়া ছিলেন জেলে বন্দি। এতে প্রমাণিত হয়, উপরের দুইটি ঘটনায়ও জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল না। ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয় সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব। জিয়াকে বের করে আনা হয় বন্দীদশা থেকে। ১৯৭৭ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রতি ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সায়েম। এ সময়কালে জিয়া ছিলেন সেনাপ্রধান এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ সালের ২০ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন বিচারপ্রতি সায়েম। এরপর প্রেসিডেন্ট এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সে সামরিক শাসন জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট ছিল না, আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাকের সৃষ্টি। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বরং তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেন।

১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার গৌরব অর্জন করেন প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়া। ঐ নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ১০ জন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসন লাভ করে বিজয়ী হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগও অংশ নিয়ে ৫৪টি আসন লাভ করে। নির্বাচনে মোট ২৯টি দল অংশ নেয়। সুতরাং জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবু সাঈদ চৌধুরী, মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম – এদের কেউই নির্বাচিত ছিলেন না। কেবলমাত্র জিয়াউর রহমানই ছিলেন প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।

তারেক রহমান ইতিহাসের আরেক সত্যও উপস্থাপন করেছিলেন। জিয়াউর রহমান কেবল বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টই নন, তিনি বাংলাদেশের প্রথম ও সূচনালগ্নের প্রেসিডেন্টও বটে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সময় জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগরের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেয়া হয়। প্রশ্ন হলো, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার গঠিত হবার সময় পর্যন্ত এই ২২ দিন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কে ছিলেন? একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে, সে দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধান থাকা আবশ্যক। সে বাস্তবতায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার সময় নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাবি করার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষকের সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্টের মর্যাদা লাভ করেন। এটিই ইতিহাসের আসল সত্য।

জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দায়মুক্তি দেয়ার জন্য ইনডিমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেননি। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডিমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল মোশতাক সরকার। জিয়াউর রহমান এমনকি যুদ্ধাপরাধ সশ্লিষ্ট বিচারের জন্য সৃষ্ট দালাল আইনও বাতিল করেননি। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, যে কিনা বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন শেখ মুজিব কর্তৃক।

তারেক রহমানের অত্যন্ত কঠোর সে সকল যুক্তির বাস্তবতা মেনে নিতে আওয়ামী নেতাদের কষ্টের যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সেটি সহজেই অনুমেয়। কেননা আওয়ামী লীগের এতদিন ধরে গড়ে তোলা মিথ্যা ও ইতিহাস বিকৃত প্রচারণাগুলো তিনি নিমিষেই ভেঙ্গে দিয়েছেন ইতিহাসের বাস্তব, কঠিন সত্যসমূহ জনসম্মুখে তুলে এনে। তাই আওয়ামী লীগের নেতারা অতীতের মতো জিঘাংসায় তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে কুৎসিত, কুরূচিপূর্ন ও অশালীন ভাষায় কটাক্ষ করতে ন্যুনতম নৈতিক শালিনতা বিবর্জিত শব্দ বেছে নিয়েছে।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রথমবার মন্ত্রীত্ব না পেয়ে যখন হতাশায় জর্জরিত, দ্বিতীয়বার তাই নেত্রীর পদলেহন করতে ভুললেন না। নিজের বয়স, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও শিষ্টাচার বর্জন করে নিজের মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে না ফেলতে তিনি নেত্রীকে খুশী করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তারেক রহমানের যুক্তিযুক্ত বক্তব্যগুলোর জবাব দেয়ার সাহস না দেখিয়ে, তাকে ব্যাক্তিগত আক্রমনের দিকেই ঝুঁকেছেন। এমনকি গলার রগ ফুলিয়ে তিনি মুখ থেকে কদর্য কিছু শব্দ ব্যাতিত যৌক্তিক কিছুই বের করেননি। তিনি তারেক রহমানকে ‘অমানুষ’ ও ‘কুলাঙ্গার’ বলে আক্রমণ করেছেন। কিন্তু তোফায়েল আহমদ মাত্র কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন, কুলাঙ্গার তারাই বলে, যারা নিজেরা কুলাঙ্গার। সে হিসেবে তারেক রহমানকে কুলাঙ্গার বলার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেই কুলাঙ্গার হয়ে গেলেন কিনা, আমরা সেটা বলতে চাই না। শেখ মুজিব নিহত হবার পর যে সকল ব্যাক্তিরা নগ্ন উল্লাস প্রকাশ করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম মতিয়া চৌধুরী আজ শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার সদস্য। তারেক রহমানকে ‘লম্বা কথা’ না বলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট-এর পুত্র তথা বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ভবিষ্যৎ পুরোধা যে তারেক জিয়া, তাকেই ‘অর্বাচীন’ বলে আক্রমণ করেছে অবৈধ স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম। কালোবিড়াল খ্যাত এক নেতা আবদার জানিয়েছেন তারেক রহমানের বক্তব্যের জন্য ‘ক্ষমা চাইতে’। নব্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ সেলিম বললেন ‘বেয়াদব’। ‘উন্মাদ’ বললেন হাইব্রিড নেতা খ্যাত হানিফ। এর ফলেই মনে হচ্ছে তারেক রহমান আওয়ামী লীগের মোক্ষম জায়গায় আঘাত হেনেছেন। বাংলাদেশ নামক দেশটির ইতিহাস নিয়ে ছেলেখেলা করার বিরুদ্ধে তিনি আঘাত করে ফেলেছেন। সেটিই আওয়ামী লীগের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তারেক রহমানের উদ্দেশ্যে একের পর এক ব্যাক্তিগত আক্রমণ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু আমাদের সেসবের জবাব দিতে হবে। তবে অবশ্যই তাদের মতো গালিগালাজ করে নয়, যুক্তি ও ইতিহাস ভিত্তিক প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের মাধ্যমে।
লেখক:ওয়াদুদ ভূইয়া সাবেক সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড

লিখাটি লেখকের একান্ত ব্যাক্তিগত

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 592 বার পঠিত হয়েছে


Subscribe to Comments RSS Feed in this post

One Response

  1. Pingback: Hoque Khata

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen