শিরোনামঃ

পার্বত্য তিন জেলা

জাতীয় সংসদ থেকে জেলা পরিষদে নারীদের ক্ষমতায়ন বাড়ানো হলেও সহিংসতা কমেনি

বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। পার্বত্য তিন জেলার কৃষি,সরকারী-বেসরকারী চাকুরী-জনপ্রতিনিধিত্ব এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহন বেশ জোরালো। একই DSC04950সাথে জাতীয় সংসদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নারীর প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা। বরং চলা চলেছে, শিশু ও নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণচেষ্টা এবং ধর্ষণের পর হত্যও মতো রোমহর্ষক ঘটনাও। আবার এসব সহিংসতার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের নজিরও একেবারে কম। ফলে নারীদের অবস্থান ভালো থাকলেও অবস্থা কোনভাবেই সুখকর নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদে রাঙামাটির সুদীপ্তা দেওয়ানকে সংরক্ষিত কোটায় সংসদ সদস্য মনোনীত করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে চাকমা রাজ পরিবারের বরেন্য নারী রাজমাতা বিনীতা রায় রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মনোনীত হন। বান্দরবানের রাজনীতিক ম্যামাচিং ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সদস্য এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিগত ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্যচুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে গঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’-এ তিনজন নারী সদস্য অর্ন্তভুক্ত হন। এই তিনজন হলেন উমে মগ, রওশন আরা বেগম এবং উনু প্রু।
দশম জাতীয় সংসদে পাহাড়ের প্রথম বাঙ্গালী নারী জে এফ আনোয়ার চিনু, সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এক্ষেত্রে চাকমা রাজা ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায়ের বিশেষ মনোযোগের প্রশংসা করেছেন, তিন জেলার নারী নেত্রীরা। তিনিও হেডম্যান কার্বারী নিয়োগে নারীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন।
তাছাড়া তিন পার্বত্য জেলার সরকারী ও বেসরকারী চাকুরিতে নারীদের অবস্থান অন্যসব জেলার চেয়ে বেশ এগিয়ে রয়েছেন।
তবে ক্ষমতা কাঠামোতে এতোসব নারীর অবস্থান থাকলেও পাহাড়ে নারী নির্যাতন কমছে না কোন ভাবেই।
নারীনেত্রী এড. সুস্মিতা চাকমা বলেছেন, পাহাড়ে বাংলাভাষীদের হাতে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। একইভাবে বাঙ্গালির হাতে বাঙ্গালি নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রবণতাও বাড়ছে।
তিনি খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে ধর্ষণের পর গৃহবধু সবিতা চাকমা হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার উদাহরণ টেনে বলেন, এখানে অহেতুক সব ঘটনাকে রাজনৈতিকীকরণ বা সাম্প্রদায়িকীকরণের মতো ম্যানুপুলেট করা হচ্ছে। এটি খুবই বাজে প্র্যাকটিস।
আইন আছে অথচ প্রয়োগ নেই। প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রেই যে ধর্ষণের আলামত জরুরী হয়ে উঠেনা। অন্যসব আলামত দিয়েও বিচার চলতে পারে এবং আইন অনুযায়ী সাজা হতে পারে। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় নারী ও শিশু নির্যাতনকে মনে হয়, অনেকটা বিচারহীনতার আওতায় পড়ে গেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে নারীদের মনোজগতে আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি বিরাগ বেড়ে যাবে।
বেসরকারী এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য জেলায় কমপক্ষে দেড় শতাধিক নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসবের মধ্যে অধিকাংশ মামলারই সুষ্ঠু তদন্ত যেমন হয়নি তেমনি হয়নি কারো দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি।
ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র নিরন চাকমা বলেছেন, পাহাড়ি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের রহস্যজনক কারণে ‘মেডিকেল টেস্ট’র ফলাফল নেগেটিভ হওয়া যেনো পাহাড়ে নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে মামলাগুলো আদালতে গেলেও প্রত্যাশিত বিচার পান না ভিকটিমরা। তিনি এক্ষেত্রে সরকার বা প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ করার অভিযোগও করেন।

নারী নেত্রী শেফালিকা ত্রিপুরা বলেছেন, পার্বত্যাঞ্চলে নারীরা জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকার কাঠামোতে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে পারলেও সামগ্রিকভাবে নারী সমাজের অবস্থা পাল্টাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের ‘পুরুষতান্ত্রিক’ মানসিকতাকে দায়ী
তিন পার্বত্য জেলায় বিশেষ করে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এবং বেসরকারী সংগঠন (এনজিও)-তে নারীদের সরব অবস্থান লক্ষ্যনীয়। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন, এমন সংগঠনও কম নয়। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এসব সংগঠন নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় সভা-সমাবেশ-মিছিল এবং সংবাদ সম্মেলনেই বেশী সক্রিয় থাকতে দেখা যায়।
বান্দরবানের নারীনেত্রী ও বোমাং রাজ পরিবারের সদস্য ডনাই প্রু নেলী বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষমতা কাঠামোতে অনেক নারীর শক্তিমান অস্থান থাকলেও তাঁরা সবাই মনোনীত। ফলে তাঁরা নিজ দলের সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক কৌশলের কাছে সবাই বন্ধী থাকতে হন।
তিনি পার্বত্য এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত এবং আরোপিতভাবে পর্যটন বিকাশকে টিনএজ নারীদের জন্য রীতিমতো আশংকায় মনে করছেন।
নেলী, পাহাড়ে নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে উঠা, ব্যবসা-বাণিজ্যে নারী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহনকে ইতিবাচক দিক মনে করেন।
টুকু তালুকদার নারী অধিকারের নানা ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ায় সক্রিয় একজন সংগঠক। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর মুল্যায়ন হলো বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো ভয়াল আক্রমনের শিকার হচ্ছেন দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষরাই। এসব জনগোষ্ঠির খাদ্য-বস্ত্র আর খাবার যোগাড় করতেই নাভিশ্বাস উঠে। তার ওপর অপরাধের শিকার হয়ে মেডিকেল রির্পোট, আইনী ঝুট-ঝামেলা, পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে সাক্ষ্য দেয়া; এগুলোতে রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। এতোসবের পর বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং মামলায় হেরে যাবার আশংকা তো আছেই। ফলে অনেক সময় সবল অপরাধীদের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন অপরাধের শিকাররা।
বেসরকারী একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে বান্দরবানের আলীকদম. লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় নারী নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। আবার খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলাতেও প্রতিবছর নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বাড়ছে। রাঙামাটির কাউখালী, লংগদু এবং বাঘাইছড়িতেও নারী ও শিশু নির্যাতনের নজির কম নয়।
কিন্তু ওই প্রতিবেদনে সময়মতো মামলার রায় হয়েছে বা সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে, অপরাধীর সাজা হয়েছে; এমন নজির মেলেনি।
উপরন্তু উল্লেখ করা হয়েছে, যতো দ্রুত অভিযুক্তদের আটক করা ততো দ্রুতসম সময়ে অভিযুক্তরা জেল থেকে বেরিয়েছেন।
পাহাড়ে পূর্নস্বায়ত্ব শাসনের দাবীতে আন্দোলনরত রাজনৈতিক সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সাংগঠনিকভাবে পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটন সম্প্রসারণের সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগকে খুব একটা ইতিবাচক চোখে দেখতে নারাজ। এরি মধ্যে সংগঠনটির পক্ষ থেকে পর্যটনসহ বিভিন্ন মেলা ও সাংস্কৃতিক তৎপরতার আড়ালে পাহাড়িদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপনের অভিযোগ তুলেছে। এই ইস্যুতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ও সভা-সমাবেশে সোচ্চার।
ইউপিডিএফ নেতা নিরন চাকমা বলেন, পর্যটনে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন মেলা, প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক ইভেন্টের নামে পাহাড়ি মেয়েদের প্রলোভিত করছে একটি মহল। চিহ্নিত এই অপশক্তিকে সামাজিকভাবে বর্জন এবং তাদের অপকর্ম রোধ করতে হবে।
তিনি এই ধরনের অপতৎপরতার ফলে নারীর প্রতি নানামুখী অবমাননাকর কার্যকলাপ বাড়ছে বলেও মনে করেন।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার শেখ মোঃ মিজানুর রহমান দাবী করেছেন, খাগড়াছড়িতে বিগত সময়ে সংঘটিত নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ভিকটিম সার্পোট সেন্টারের মাধ্যমে সেবা দেয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 730 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen