বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণীত হয় ১৯৯২ সালে।ইউ জি সি থেকে প্রাপ্ত তথ্যঅনুযায়ী দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৮ টি ।দেশে প্রতি বৎসর বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলছে । প্রতি বছর উচ্চ মাধ্যমিকে বাড়ছে জি পি এ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাএকই হারে বাড়ছে জি পি এ ৪ থেকে ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা । দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই জায়গাকরে নিতে পাড়ছে না সীমিত আসন সংখ্যার কারনে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জটে অনার্স শেষ করতেএকজন শিক্ষার্থীর সময় লেগে যায় ৬/৭ বছর । বিগত দিনগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে দেশেরপাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশন জট লেগে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে দিচ্ছে । উচ্চবিত্ত ,উচ্চমধ্যবিত্ত তাছাড়া বর্তমানে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরও উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে দেশেরবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে । বর্তমান সময়ে ইউ জি সি থেকে পাওয়া এক বার্ষিক প্রতিবেদনে এসববিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় । দেশের ৬০ টি বিশ্ববিদ্যল্যের একাডেমিক কার্যক্রমের তথ্য আছে ইউ জি সি এর কাছে । গ্রেডিং পদ্ধতি বা পাঠ্যক্রমের মধ্যে মিল নেই এসববিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে । এক এক বিশ্ববিদ্যালয় এক এক পদ্ধতি অনুসরণ করছে । বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেশিক্ষক যে কোর্স পড়াচ্ছেন তিনিই ঐ কোর্সের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন , উত্তরপত্র মূল্যায়ন সহ চূড়ান্ত গ্রেড দিচ্ছেন । ঐশিক্ষকের যোগ্যতা বা দক্ষতার উপর নির্ভর করছে একজন ছাত্র কি অর্জন করছে যা দিয়ে সে তার ক্যারিয়ারগড়বে বা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাবে । অনেক ক্ষেত্রে বহিরাগত বা আভ্যন্তরীণ বিশেষজ্ঞ দ্বারা যাচাই করা হচ্ছে না এর যথার্থতা । শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে নেই কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি । অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই বাহির থেকেখন্ডকালীন শিক্ষক এনে ক্লাস করাচ্ছে। অধিক লাভের জন্য শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে ইচ্ছামত। দেশের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য । বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধিকাংশই মার্কেটের ভিতরে, গার্মেন্টসের উপরে,হোটেলের ভিতরে তাদের ক্যাম্পাস চালু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্মুক্ত ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীর মেধা ওমননের বিকাশে সহায়তা করে । টিউশন ফির সুনির্দিষ্ট কোন কাঠামো নেই অধিকাংশ বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয়ে।শিক্ষার্থীরা পত্র পত্রিকায় বা ভর্তির সময় সংগ্রহ করা কাগজ পত্রে যে বেতন কাঠামো দেখে ভর্তিহচ্ছে পড়তে গিয়ে দেখছে তার কোন মিল নেই । ভর্তির পর অনেক লোকানো খরচ বেড়িয়ে আসছে । এর ফলেশিক্ষার্থীর অভিবাবকেরা অনেক সময় হিম শিম খাচ্ছে । মাঝ পথে এসে পরিবর্তন করতে হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বি বি এ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এ শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে । বর্তমান বিংশ শতাব্দীতে বি বি এ এর চাহিদা থাকলেও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াবাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হওয়া স্নাতকদের মান তেমনটা ভাল নয় । হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারিবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রদান করছে মানসম্মত শিক্ষা। এদের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় , ব্র্যাকবিশ্ববিদ্যালয় , ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় , আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ,ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং আহসানউল্লাহবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় । এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা নিলেও অনেক সময়দেখা যায় ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ হারে এককালীন টাকা নিয়ে ভর্তিকরাচ্ছে ।
যারা ভর্তি পরীক্ষায় না টিকে উচ্চ টাকা দিয়ে ভর্তি হচ্ছে, তাদের অনেকেই দু তিনটি সেমিস্টার পড়ার পর নিম্ন সি জি পি অর্জন, পড়াশুনার চাপের জন্য বের হয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে উচ্চ সি জি পি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে ।গ্রেডিং পদ্ধতির পার্থক্যের জন্য দেখা যাচ্ছে ক্রেডিট ট্রান্সফারের ফলে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন সি জি পি এ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ সি জি পি এ তে পরিণত হচ্ছে । এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে । পি এইচ ডি ধারী সহ , দেশি-বিদেশী ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের পূর্ণকালীন এবং খণ্ডকালীন হিসেবে শিক্ষাদানের জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ দিচ্ছে । কিন্তু তাদেরকে ধরে রাখতে উচ্চ হারে বেতন দিতে হচ্ছে । সেজন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এইসব বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক পর্যায়ের টিউশন ফি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ছয় লক্ষ থেকে আট লক্ষ নিচ্ছে । যা কেবলমাত্র উচ্চবিত্তের পক্ষেই বহন করা সম্ভব । মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা পাহাড়সমান এ টাকার বোঝার জন্য মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করা সত্ত্বেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না । উচ্চ শিক্ষার পথ যাতে রুদ্ধ না হয় সেজন্য বেছে নিচ্ছে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের মান এবং তাদের মূল্যায়ন পদ্ধতির অসমতার কারনে মানস্মত শিক্ষা না নিয়েই গ্রায়জুয়েট হচ্ছে , এর ফলে বর্তমান প্রতিযোগীতাপূর্ণ চাকরির বাজারে তাকে পিছনে পড়ে থাকতে হচ্ছে ।
৬০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৫-১৯ বছরের মধ্যে হওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব বা স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেনি এবং এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ পর্যন্ত মাত্র ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও প্রদান করছে না মানসম্মত শিক্ষা । ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি তাদের নিজস্ব ক্যম্পাস এ গেলেও ইউ জি সি এর অনুমোদনহীন কিছু বিষয় পড়াচ্ছে এবং ছোট আকারের পাঠ্যসূচী দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঢিলেঢালা ভাবে কোর্স পড়িয়ে উচ্চ সি জি পি এ দিচ্ছে ।
২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নতুন আরো ছয়টির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার অনুমোদন দেয়া হয়ছে । সর্বশেষ এ ছয়টি নিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে মোট ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেল । সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতি এবং সিলেবাসের মধ্যে সাদৃশ্য থাকা উচিত , যাতে মানের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য সৃষ্টি না হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক , বানিজ্যবিহীন করতে হবে । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামো, ফ্যাকাল্টি ও পরিবেশগত বিষয়ে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সচেষ্ট হতে হবে । শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের নীতিমালা মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং টিউশন ফির সুনির্দিষ্ট কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে ।ভাল মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গরিব মেধাবীদের পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া উচিত ।
জুবায়ের আল মাহমুদ ,
লেখক এবং শিক্ষার্থী , ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি