শিরোনামঃ

কপাল পোড়া শ্রমিক বনাম মদীনার শ্রমিক – মাওলানা আলাউদ্দিন ইমামী

কপাল পোড়া শ্রমিক:-

তোমাদের ভাগ্য নিয়ে পরিহাস। হাড় ভাঙা খাটুনি দিয়ে গড়ে তোল এমারত। মুজুরীটাও পাওনা ঠিকভাবে। পান্থা আনতে নুন পুরায়, খেতে পার না পেঠ ভরে। অতৃপ্তই থেকে যায়images মনের সাধ। তোমার রক্ত আর ঘামে ভেজা অট্টালিকায়, ধনীর দুলালেরা আরাম কেদারায় ফূর্তি করে। তোমার আদুরে ছেলেটা গাছতলায় বড় হয়। তাকে দিতে পার না সোনালী ভবিষ্যতের কোন আশ্বাস। তোমার হাতে গড়া সেই অট্টালিকায় ঈদের দিনেও যাওয়ার সুযোগ পায় না তোমার ছেলে। তুমি বন্যার পানিতে ভাস। ওরা ছাদে বসে তামাশা দেখে, আর হাসে। তোমার পরিবার একটু উন্নত ও ভাল খাবার শবে বরাতের রাতেও না পেয়ে আত্মহত্যা করে। ক্ষোভে হতাশায় ধুকে ধুকে মরে। ধনীর ঘরের ছেলে কোরমা পোলাও আর মুরগীর আধা খাওয়া রোষ্ট নিচে ফেলে দেয়। তার একটুও ভাগ্যে জোটেনা গরীব শ্রমিকের ছোট বাচ্চাদের। কত হাসপাতাল তৈয়ার কর তুমি। তোমার অসুস্থ ছেলে মেয়ের চিকিৎসা হয় না। চিকিৎসার অভাবে রোগের জ্বালায় ধুকে ধুকে মরতে হয় তাদের। তোমার শ্রমের কাধে সওয়ার হয়ে ধনীরা হয় হাজার কোটি টাকার মালিক। তোমাকে চলতে হয় ছেড়া কাপড় পরে। আগুনে তোমার ঘর আগে পুড়ে। বন্যায় তোমার ঘরটাই আগে ডুবে। সারা জীবন পরের জন্যই শুধু ইমারত বানাও। নিজের পর্ণ ঘরটা চুনকাম করতেও পারলে না জীবনে একবার। জীবন দিয়ে রক্ত দিয়ে, করম আলীকে নেতা বানাও। সে হয়ে যায় পুঁজিপতি। তুমি থেকে গেলে সেই খেটে খাওয়া দুঃখী মানুষ। গরীব দরদী সেজে মুখরোচক কত বক্তৃতাই না সে দিয়েছে। এখন তোমাকে চেনেই না। তোমার শ্রমে ঘামে বিল্ডিং হল। ভবন হল, পুল হল, ব্রীজ হল, সুন্দর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প কারখানা সবি হল। শুধু তোমার কিছু হল না। গাড়ী হল না, হল না বাড়ী, তোমার সুখ স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। না তোমার বস্তী ঘরের উন্নতি হল। না তোমার ছেলে, মেয়ে, বউ ঝিয়ের কপাল খুলল। এভাবে দিন, মাস বছর যায়। তোমার শ্রমেই গড়ে উঠে শহর, নগর বন্দর। তুমি কিন্তু থেকে যাও আগের মতই মেহনতি শ্রমিক। গরীব জনতার সাথী। একটু অধিকার আর ন্যায্য পরিশ্রমিকের কথা বললেই নেমে আসে হামলা ও মামলা। না থানায় তোমার বন্ধু আছে। না আদালতে আছে তোমার জন্য যথাযথ কোন সুবিধা। যৎ কিঞ্চিত যা সুবিধা কিছু আছে তাও পেতে কত ঘাট মাড়াতে হয় তা শুধু তুমিই জান। আদালত পাড়ায় ঘুরাটাই তোমার সার। এভাবে দরিদ্র থেকে তুমিই প্রিয় জনদের সুখ দুঃখের ছবি এঁকে এঁকে দুনিয়া থেকে বিদায় নাও। একটু বেশী কিছু বললেই তারা তোমাকে লাঠিপেটা করে। আর বলে, আমরা এসব দেশের মহলের জন্যই করি। আল্লাহ বলেন যখন এদেরকে বলা হয় তোমরা বাড়াবাড়ি আর ফ্যাসাদ সৃষ্টি করিও না, তখন তারা বলে, আমরা মঙ্গলের জন্যই এ রকম করি। আল-কোরআন। এ চরিত্র বেনামাজি বেঈমান মুসলমানদের হতে পারে। যারা অর্থলোভী, ক্ষমতালোভী, আল্লাহর ভয় আখিরাতের ভয় যাদের নেই তারা এমন হতে পারে। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে অনেক নামাজি কালামী মুসলমানও শ্রমিক ও গরীব জনতার হক ও অধিকার নষ্ট করতে কোন সংকোচ করছে না। এরা আল্লাহর নিকট কি জওয়াব দিবে?

মে মাস মে দিবস:-
প্রায় ১২৬ বছর আগে, ন্যায্য অধিকারের দাবীতে, আমেরিকার শিকাগো শহরে প্রাণ দিয়েছিল ১০ জন শ্রমিক। সেই শ্রমিকের স্বরনে, ১৮৮৬ সালের ১লা মে’র ঐদিনের বিদ্রোহ দিবসকে ঘিরে বিশ্বে পালিত হয় শ্রমিক দিবস। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে যুগ যুগ ধরে সেই দিবস পালনই শুধু হয়। শ্রমিক পায় না তার ন্যায্য পারিশ্রমিক। বঞ্চিত তার অধিকার থেকে। এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে মানবিক আচরন পাওয়া থেকেও সে মাহরুম। এ হচ্ছে তথাকথিত আধুনিক বিশ্বে প্রগতিশীল মানুষের মানবিকতার ঘৃন্য নিদর্শন। পুরো মে মাস, মে দিবস কে ঘিরে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আর পারিশ্রমিক আদায়ের নামে বিশাল সমাবেশ মিছিল হয়। সভা সেমিনার হয়। যুগ যুগ ধরে নানা রকম আলোচনা আর বক্তৃতা হয়ে আসছে। এতে বক্তা আর নেতাদের ভাগ্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মেহনতি শ্রমিক জনতা কি ফিরে পেয়েছে, তার ন্যায়নুগ, মানবিক মর্যাদা ও অধিকার। হাজার হাজার দিন মজুর, লাল লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক আর খেটে খাওয়া মানুষ এখনো শুধু অধিকার বঞ্চিত নয় পাশবিক অত্যাচারেরও শিকার। মানবিক চিন্তা, জওয়াব দিহিতার অনুভূতি, পরকালীন ভয় আর নৈতিক মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ছাড়া শুধু সভা সেমিনার আর দিবস পালন দিয়ে কি এদের সমস্যার সমাধান হবে। শ্রমিক জনতা মেহনতি মানুষ কি ফিরে পাবে তার মানবিক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। জাতিসংঘ কি দিবস পালন ছাড়া এর কিছু দিতে পেরেছে? বরং জাতিসংঘকে দেখা যায় তেলে মাথায় তেল দিতে। প্রকৃত পক্ষে কেউ যদি মেহনতি জনতা ও শ্রমিক শ্রেণীর যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার ফিরে পেতে অথবা ফিরিয়ে দিতে চায়, তাদের ১৫০০ বছর আগে নবী মুহাম্মদ (দঃ) গরীব জনতা ও শ্রমিক শ্রেণীর জন্য যে মর্যাদা ও অধিকার ঘোষণা করেছেন, তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও প্রতিষ্ঠানে। তাহলেই শুধু ন্যায্য অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ফিরে পাবে শ্রমিক সমাজ। মেহনতি মানুষ। কারণ শুধু ইসলামই দিতে পারে সকল শ্রেণীর মানুষকে মানবিক সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার। এই কারনেই ইসলাম যুগউপযোগী পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং মানবতার ধর্ম।

মদীনার শ্রমিক:-
তখন মদীনা একটি ছোট শহর। মক্কা থেকে হিজরত করে মহানবী (সঃ) মদীনায় গেছেন মাত্র। মুহাজির আগমন করায় মদীনা এখন শ্রমিক, কৃষক ও ব্যবসায়ীর দেশ। নগরপতি হিসাবে আছেন প্রিয় নবী (দঃ)। শ্রমিকেরা কাজ করে ন্যায্য মূল্য পায়। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ পায়। মানবিক ব্যবহারে তারা উৎফুল্ল। শ্রমের মূল্য পেয়ে যাচ্ছে সাথে সাথে। কোন চাপ নেই। বাড়তি কাজের ভীর নেই। কাজ একটু বেশী হলেই, মুনিব এসে পাশে দাড়ায়। সহযোগীতা করে কাজে। একটু অসুবিধা হলে মুনিবের বন্ধুরা সহ এসে যায় শ্রমিক ভাইয়ের সাহায্যে। মানবতা, ভ্রাতৃত্ববোধ আর সহযোগীতার এক মনোরম পরিবেশ। মনিবের কাজ সারাদিন করলেও যেন সে কাজ বোঝা হবে না। ইচ্ছা হবে না অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবী করতে। আল্লাহ বলেন, তোমাদের সম্পদে বঞ্চিত শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আছে। অধিকার আছে যারা অভাবী, প্রার্থী তাদের। শ্রম বিনিময় ছাড়াও তাদেরকে অতিরিক্ত সাহায্য কর। আল-কোরআন। আল্লাহর এমন ঘোষণার কারনেই মদীনার মুসলমান মুনিব ও মালিকদের এই চরিত্র। দুনিয়ার মানুষ এমন অনুপম দৃশ্য কি আবার দেখবে? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল মদীনার নগরপতি স্বয়ং শ্রমিকের সাথে একাকার হয়ে, শ্রমিক সেজে, তিনিও লাকড়ি কুড়ান। তিনিও মাটি কাটেন, শ্রমিকের সাথে। তিনিও বোঝা বহন করেন। তিনি শ্রমিক হয়ে বাগানে খেজুর চারা লাগান। বুড়ো শ্রমিকের কষ্ট দেখে নিজেই দূর থেকে এনে বাগানে পানি দিয়ে দেন। তিনি শুধু একজন মানুষ নন। তিনি হলেন বিশ্বজগতের শ্রেষ্ঠ নবী (দঃ)। তাঁর সাথে তাঁর সাথীরাও ছিলেন তেমন রকমের মহানুভব মানুষ। হযরত আবু বকর (রাঃ) রাষ্ট্র প্রধান হয়ে একজন গরীব বৃদ্ধ মহিলার ঘরের কাজ করে দিতেন। হযরত ওমর (রাঃ) শ্রমিককে উঠের পিঠে বসিয়ে নিজে উঠের রশি টেনে নিতেন। ইসলামের পঞ্চম খলিফা ওমর বিন আবদুল আজীজ ঘুমন্ত শ্রমিককে পাখা করতো গরমে। এ রকম আর কত ইতিহাস। সকলেই যেন শ্রমজীবি মানুষের পরম আত্মীয়। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেন, রাছুলের জীবনে তোমাদের জন্য আদর্শ আছে, উত্তম আদর্শ, আল-কোরআন। এই জন্যই আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে আজ পরিপূর্ণ করে দিলাম। আল-কোরআন।

প্রিয় নবী (দঃ) বলেন:-
শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে তার মজুরী দিয়ে দাও। তাকে সামর্থের বাইরে বোঝা দিও না। কাজ যদি একটু বেশী হয়, কাজে সহযোগীতা করিও তার। তারা তোমাদের ভাই, তুমি যেমন খাও তাদেরকে তেমন খেতে দিও। যেমন পোষক তুমি পর, তাদেরকে তেমন পোষাক পরিধান করতে দিও। খবরদার শ্রমিক যদি অমুসলিমও হয়, তার পাওনা নিয়ে টালবাহানা করা যাবে না। ন্যায্য পাওনা তাকে দিতেই হবে। সামর্থের বাইরে, অতিরিক্ত কাজ দেয়া যাবে না। কষ্ট দেয়া যাবে না। তার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন তাকে কাজ করার জন্য চাপ দেয়া যাবে না। ব্যতিক্রমে হলে কেয়ামতের দিন তার পক্ষ হয়ে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দাঁড় করাব। আল হাদীছ। দুনিয়ার তথাকথিত শ্রমিক দরদী, প্রগতিশীল রাজা বাদশা, নেতানেত্রী আর সরকার, শ্রমিককে এমন মানবিক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ অধিকার ও আচরণ কি দিতে পেরেছে? দিবে? শ্রমজীবী মানুষের উচিত ন্যায্য ও মানবিক মূল্যবোধ বিশিষ্ট শ্রমনীতি পাওয়ার জন্য ইসলামী শ্রমনীতি চালু করা এবং তার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সংগ্রাম করা। কারণ শুধু ইসলামী আদর্শের পক্ষেই শুধু সম্ভব শ্রমিক ও মেহনিত মানুষের যথাযথ মর্যাদা সম্মান ও অধিকার প্রদান করা। পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার শোষণ, সমাজতান্ত্রিক কয়েদখানার বন্দী দশা শ্রমিকেরা অনেক অনুভব করেছে। আর নয়।
লেখক মাওলানা আলাউদ্দিন ইমামী খতীব বান্দরবান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 764 বার পঠিত হয়েছে


Subscribe to Comments RSS Feed in this post

One Response

  1. Pingback: Noor Bhoiya

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen