শিরোনামঃ

আওয়ামীলীগের জাতীয় সম্মেলন এবং পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ জনপ্রিয়তা ; প্রদীপ চৌধুরী

গতকালের পর
‘ওয়ান-ইলেভেন’ পরবর্তী বিগত ২০০৮ সালের শেষ মুর্হুতে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশের মতো নৌকার জোয়ারে ভেসেছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই নির্বাচনে ভোটের পরিসংখ্যান খুব একটা ভালো ছিল না। ক্ষমতার ২০০৯-২০০১৩ এই মেয়াদের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে বিডিআর বিদ্রোহসহ অনেক রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে, জাতির alপিতার আত্মস্বীকৃত খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশে এবং বর্হিবিশ্বের ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে আছে।
এই কঠিন সময়েও সরকার তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়নে রের্কড পরিমাণ উচ্চতায় পৌঁছেছে। রাঙামাটি জেলার বাঘাইহাট ও জেলা শহরে এবং খাগড়াছড়ি জেলার হাফছড়ি, জেলা শহর ও মাটিরাঙার তাইন্দংয়ে বহুমাত্রিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। মন এবং ঘর ভেঙেছে শত শত মানুষের। এসব ঘটনার সুষ্ঠু কোন বিচার বা তদন্ত; পাহাড়ের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি।
বিশেষ করে, জামাতের যুদ্ধাপরাধ বিচার বিরোধী আন্দোলনের নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ী ও মঠ-মন্দির জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি এবং বিএনপি’র ৯০ দিনের পেট্রোল বোমার কর্মসূচিতে বাংলাদেশ অন্য এক বিরাণভূমিতে পরিণত হয়।
ফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপি বিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের মানুষ সারাদেশের মতো তিন পার্বত্য জেলাতেও কৌশলগত কারণে দুটি আসনে সরকারী দলের প্রার্থীকে জয়ী হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু রাঙামাটিতে ধরাশায়ী হন, পাহাড়ের শক্তিশালী নেতা দীপংকর তালুকদার। একই সাথে ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়েন, কেন্দ্রর নেতা এবং বান্দরবানের টানা পাঁচ বারের এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিং। খাগড়াছড়িতে নির্বাচিত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাও জিতেন ইউপিডিএফ প্রধান প্রসিত বিকাশ খীসার সাথে মাত্র ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে। যেখানে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই তফাৎ ছিল আকাশ-পাতাল। ভোটের হিসেবে এই জয়, অতীতের সবকটি নির্বাচনকে ম্লান করেছে নি:সন্দেহে।
বিপুল উন্নয়নকে ছাপিয়ে এই নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, পাহাড়ে আওয়ামীলীগ সরকারের জনপ্রিয়তায় ক্রমশ: ধ্বস নেমেছে। কিন্তু কেনো, এমন হলো?
আমরা সাধারণ নাগরিকরা নির্বাচনী হলফনামার সূত্র ধরে প্রত্যক্ষ করলাম, সমতলের মতো এখানকার মাননীয় সংসদ সদস্যদের অর্থ-বিত্তও ব্যাপক হারে বেড়েছে। যদিওবা তাঁদের কারোরই সুনির্দিষ্ট কোন ব্যবসায়িক ঐতিহ্য বা অবস্থান আমাদের জানা নেই।
তথাকথিত ‘মৌসুমী ব্যবসা’র বদৌলতে একজন মাননীয় সংসদ সদস্য কতোটা অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যেতে পারেন; তা আমরা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। একই সাথে তাঁদের নিজ নিজ জেলায় দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমটাও কেমন নড়েবড়ে হয়ে উঠেছে, তাও আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি।
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত প্রতিটি সংসদীয় আসনের সবকটি উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারী দল হিসেবে আওয়ামীলীগের বিপুল হার, সরকার এবং দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কেমন ঠেকেছে; তা আমাদের বেমালুম।
এমন পরিস্থিতি কিংবা সাংগঠনিক ও জনুপ্রয়তার জনমিতিক বিপর্যয় সমতলেও ঘটেছে। এতোসব কার্য কারণের পরেও বলতে হয়, পার্বত্য এলাকা ২০-তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে চরম বঞ্চনার শিকার হয়েছে। কারণ, এখানকার রাজনৈতিক নেতাদেরকে যেসব অনুল্লেখ্য অবস্থা ও অবস্থান মোকাবিলা করতে হয়, তা সমতলে একেবারেই অকল্পনীয়।
এখানকার তিনটি আসনের জনবৈচিত্র্য, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা একবারেই ভিন্ন। যা এখানে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস না করলে বোঝার উপায় নেই। থিওরিট্যাকেলি পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণায় অনেক কিছু উঠে আসে। শত শত ঋদ্ধ জর্ণাল অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জানা। এসব কতোটা এই অঞ্চলের মানুষকে ছুঁয়ে গেছে তাও প্রশ্নবিদ্ধ।
আমাদের সরকার বা দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামীলীগ’ কখনো কখনো কোন গবেষণা কাঠামো দাঁড় করেন নি; যাতে দেশের মানুষ বুঝতে পারেন বীর বাহাদুর, দীপংকর বা কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা’রা কতো কঠিন দু:সময় মোকাবিলা করে নৌকার মাঝি হিসেবে টিকে আছেন?
বাংলাদেশের বেশীরভাগ জেলায় ভোটারদের হয় মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ বা খ্রীস্টান মেজরিটি অথবা সংখ্যালঘু। এখানে সবাই যেহেতু জাতিগত ভাবে বাঙালি, সেহেতু নির্বাচনী প্রচারণায় মূখ্য হয়ে উঠে আওয়ামীলীগ-বিএনপি। এর বাইরে অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় উদারতার প্রশ্নটি সামনে থাকে।
কিন্তু পার্বত্য তিন জেলাতে আওয়ামীলীগের যিনি প্রার্থী, তিনি পাহাড়ি-বাঙালির প্রশ্নে কতোটা লিবারেল অথবা তিনি কোন সম্প্রদায়ের, তাও হঠাৎ সামনে চলে আসে।
সমতলের খুব বেশী আসনে তিন/চারটের বেশী জাতিগত সংখ্যালঘুর উপস্থিতি মেলে না। কিন্তু এক বান্দরবানেই ১৩ অথবা ১৪টি জাতিগোষ্ঠির অবস্থান। রাঙামাটিতেও ৮ থেকে ১০টি। খাগড়াছড়ি আসনে পাহাড়ি জাতিস্বত্তার বাইরে সেটেলমেন্ট এলাকায় বসবাস করেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলা এবং উপজেলার মানুষ।
এতোসব মানুষের মন জয় করে ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরকারী দল হিসেবে অসাম্প্রদায়িকতার ঝান্ডা তুলে ধরে নির্বাচন করা অনেক দুরুহ।
এই দুরুহ কাজটি করতে গিয়ে বীর বাহাদুর, দীপংকর কিংবা কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা’রা কী খুব বেশী সংখ্যাগরিষ্ট নেতাদেরকে পাশে পান? যদি পেতেন, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দিনে-দুপুরে কোন মানুষের ঘরবাড়ী পোড়া যেতো না। একই স্টাইলে একের পর এক সাম্প্রদায়িক অপরাধ সংঘটিত হতো না।

 

চলবে

 

প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 664 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen