বিগত ১৯৯১ সাল থেকে ঠিকাদারী ব্যবসা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। তখন পাহাড়িদের মধ্যে ঠিকাদারীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় হাতেগোনা মানুষই যুক্ত ছিলেন।
তাঁর হাত ধরেই পাহাড়িদের অনেকে এই পথে পা বাড়িয়েছেন এবং সফলভাবে টিকেও আছেন।
তিন দশকের বেশী সময় ধরেই দাপটের সাথে ব্যবসা করেছেন।
সময় পাল্টেছে, পাল্টে গেছে পাহাড়ে ঠিকাদারী ব্যবসার সহজ সমীকরণও। এক সময় চিন্তা করলেন, স্থায়িত্বশীল এবং কর্মসংস্থানমুখী ব্যবসা করা চায়। সেই চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে জেলাশহরের মিলনপুরস্থ নিজস্ব জায়গায় ১ কোটি টাকা বিনিয়োগে আবাসিক হোটেল নির্মাণকাজে হাত দেন। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই গ্রাহকদের সামনে আত্মপ্রকাশ ঘটান বিলাসবহুল ‘গাইরিং হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট’র। এখন যেখানে তাঁর বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
শুরুতে একটি আবাসিক এলাকায় আবাসিক হোটেলের ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকে উস্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু বছর না যেতেই আশার আলো দেখেন তিনি এবং অন্যরাও।
প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারী ব্যবসা থেকে তিনি এখন পুরোদস্তুর পর্যটন উদ্যোক্তা। তিনি শুধু নন, বিগত আধাযুগে খাগড়াছড়ি জেলাশহরে গড়ে উঠেছে, ২৫টি ছোট-বড়ো আবাসিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ এবং ডরমেটরি।
বর্তমানে তিনি খাগড়াছড়ি হোটেল-মোটেল মালিক এসোসিয়েশনের সাঃ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করছেন।
অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা, পর্যটন ব্যবসাকে সামাজিক দায়বদ্ধতা, রাজনীতিমুক্ত, কর্মসংস্থান, পারিবারিক আয়ের ভিত্তি এবং সর্বোপরি সেবা ও আতিথেয়তার ক্ষেত্র হিসেবেই চিহ্নিত করেন।
খাগড়াছড়ি জেলায় পর্যটন খাতের বিকাশের বিপুল সম্ভাবনার আলো যেমন তাঁর চোখেমুখে। তিনি মনে করেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় পাহাড়-সমতল এবং নদী মাতৃকতার যে সমন্বয় ঘটেছে, তা দেশের অন্য কোন জেলাতেই নেই। বিশেষায়িত পর্যটন স্পটগুলো ছাড়াও এখানকার জাতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, খাদ্যাভাস, হস্তশিল্প যেকোন মানুষের মনোযোগ আকর্ষন করতে সক্ষম।
তিনি মনে করেন, ‘পর্যটন’ ব্যবসা এমন একটি খাত, যেটির সাথে পরিবহন, খাবার, স্থানীয় শাক-সবজি, ফলমুল এবং শিল্প-সংস্কৃতি পর্যন্ত জরুরী। একদল পর্যটকের আগমনের সাথে পাল্টাতে থাকে ওই এলাকার জীবনমানের অর্থনৈতিক নিক্তিও।
মোটাদাগে হয়তো সেটি রাতারাতি দৃশ্যমান না হলেও গত একদশকে ব্যবসার সাথে বা উদ্যোক্তা হিসেবে সম্পৃক্তদের কাছে বিষয়টি মোটামুটি পরিস্কার।
নিজের প্রতিষ্ঠান ‘গাইরিং’-এর বার্ষিক টার্নওভার এখন ১৫ লক্ষ টাকা হলেও তিনি তাতে সন্তুষ্ট। কারণ, দিনকে দিন পর্যটকের আনাগোনা যেমন বাড়ছে তেমনি টাকার ঘরটিও বড়ো হতে চলেছে।
খাগড়াছড়ি জেলাশহরে নির্মাণাধীন এবং নিকট ভবিষ্যতে চালু হবার পথে থাকা বেশক’টি বড়ো বাজেটের হোটেলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি জেলাটি ভৌগলিক কারণে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার সাথে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত। ফলে এই জেলার পর্যটন স্পটগুলো যেমন পর্যটকরা দেখতে পান; তেমনি বাংলার ভূ-স্বর্গখ্যাত ‘সাজেক ভ্যালী’ ঘুরে দেখা অথবা লংগদু হয়ে কাপ্তাই হ্রদে ভাসার রোমাঞ্চ বাড়তি পাওনা।
যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার এবং পরিবহন নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে অপর দুই পার্বত্য জেলার চেয়ে খাগড়াছড়ি এগিয়ে থাকার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি জেলার সাথে বিভিন্ন উপজেলা এবং উপজেলার সাথে প্রত্যন্ত এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটছে। সড়ক সম্প্রসারণ, সেতু উন্নয়নসহ জেলার সাথে ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগ ক্রমেই কমে আসছে। এখানকার আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতাও আস্তে আস্তে পর্যটনবান্ধব হয়ে উঠছে। চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই জেলাশহরের সবক’টি হোটেল ব্যবসার শুভ সূচনা করেছে। এসব মাপকাঠিই ইঙ্গিত দিচ্ছে, ‘খাগড়াছড়ি’ আগামী দিনের পর্যটন ব্যবসার উর্বরভূমিতে পরিণত হবে।
তিনি মনে করেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, পর্যটন কর্পোরেশন, পাহাড়ের স্থানীয় সরকার কাঠামো ও প্রশাসন যদি পাহাড়ের পর্যটন খাতকে অর্থনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে চিহ্নিত করার সময় এসেছে। সে অনুযায়ী সমীক্ষা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, ঋনের ব্যবস্থা এবং ‘ট্যুরিজম পুলিশিং’ কার্যক্রম হাতে নেয়া প্রয়োজন।
তিনি পর্যটকদের মাঝে পাহাড়ি সংস্কৃতি ও মুল্যবোধ নিয়ে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পর্যটকের প্রত্যাশিত শ্রান্তি ও বিনোদনের জন্য প্রশিক্ষিত ‘ট্যুর গাইড’ কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে।
তবে অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা, স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন, এলাকার দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক স্বার্থ, মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা পর্যটন বিকাশে অনেক বেশী সহায়ক হতে পারে।