শিরোনামঃ

রাঙামাটি জেলা প্রশাসককে চাকমা রাজার চিঠি

সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ১০ জানুয়ারি ক্লাশ চালু নিয়ে উদ্ভুদ পরিস্থিতি নিয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন আজ মঙ্গলবার জরুরী আইন শৃঙ্খলা সভার DSC07623আয়োজন করে। এতে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ও থাকার কথা ছিল, কিন্তু তিনি সভায় থাকতে না পারায় একটি অফিসিয়াল চিঠি জেলা প্রশাসক, স্থানীয় দুই সাংসদ এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে পাঠান। এটি নিম্নে দেয়া হলো-

বিষয়: রাঙ্গামাটির ডিসি। ১৩ জানুয়ারির শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সভা, ১০-১২ জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত র্ঘটনা।

১০-১২ জানুয়ারি সহিংসতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পর রাঙ্গামাটি শহরে শান্তি এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য সভার আয়োজন করায় জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন নিম্নস্বাক্ষরকারী। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সঠিক, সুষ্ঠু ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নিজের পূর্ন সহায়তার আশ্বাস দিচ্ছেন তিনি। তিনি চাকমা সার্কেল প্রশাসনের পূর্ন সহযোগীতাও নিশ্চিত করছেন। তিনি এ চিঠি লিখে এ বিষয় সম্পর্কে নিজের মতামত প্রদান করার সুযোগ গ্রহণ করছেন। এ ঘটনাবলী সন্দেহাতীতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের উপর গুরুত্বপূর্ন প্রভাব পড়েছে। সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০-এর ৩৯ ধারা এবং অন্যান্য প্রযোজ্য আইন ও রীতিনীতি মোতাবেক, তিনি এ বিষয় নিয়ে আইনগতভাবে জেলা প্রশাসককে পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার রাখেন। এ মতামত মূলত সাম্প্রতিক সময় এবং গত দশক ধরে গড়ে উঠা জনমতের উপর ভিত্তি করে যা নিম্নস্বাক্ষরকারী নিজের ধর্তব্যের মধ্যে রেখেছেন।Raja--

 

 

 

 

 

 

 

 

 

উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের পরামর্শ

নিম্নস্বাক্ষরকারী প্রবলভাবে পরামর্শ দেন যে, সরকার কর্তৃক তদন্ত কমিশন গঠন করে, (১) সংঘটিত ঘটনা তদন্ত করা হোক, (২) বেআইনি সহিংস কার্যক্রম (ষড়যন্ত্রকারী, জড়িতদের আশ্রয়দাতারা সহ) সংঘটনের দায়ে জড়িতদের শাস্তির ব্যাপারে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যম-মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ করা হোক (৩) ভবিষতে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হোক।

এ কমিশন হতে হবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। প্রয়োজনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন এ কমিশনের সরকারী কর্মকর্তা সহ যেকোনো ব্যক্তিকে তলব করার ক্ষমতা থাকবে। যেকোনো স্থানে প্রবেশ ও দলিল পাওয়ার ক্ষমতা সহ অন্যান্য ক্ষমতা থাকবে। ১৯৫৬ সালের তদন্ত কমিশন আইনের অধীনে গঠিত কমিশনের, উদাহরণস্বরুপ, কোনো ব্যক্তিকে তলব করা, পরীক্ষা করা ও পূর্বক্ত আইনানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করার জন্য এটি গঠিত হতে হবে সেসব ব্যক্তিদের দ্বারা যাদের দক্ষতা ও সততা প্রমাণিত, যেমন, বর্তমান বা সাবেক বিচারিক কর্মকর্তা (হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক সহ) এবং/অথবা সুশীল সমাজের সদস্যবৃন্দ।

মিশ্র পুলিশী ব্যবস্থার উপর সুপারিশ
নিম্নস্বাক্ষরকারী আরও সুপারিশ করেন যে ভিন্নভিন্ন জাতি, ভাষাভাষি, ধর্ম, জন্মগ্রহনের স্থান থেকে নারী সহ পুলিশ বাহিনী রাঙ্গামাটি সহ পার্বত্য জেলাসমূহে মোতায়েন করতে সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে জরুরী ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক। এ মোতায়েনের ফলে ১) আরও ভালো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা যাবে, ২) এ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বিষয়াবলী সম্পর্কে পুলিশ সদস্যরা গভীর ধারনা অর্জন করবে, ৩) পুলিশ সদস্যদের জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও জন্মস্থান সংক্রান্ত যেকোনো বৈষম্য রোধে সহায়তা করবে। এ ধরণের ব্যবস্থা গ্রহন করলে, ভিত্তিহীন গুজবের মাধ্যমে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির উপর হামলা রোধ করা যাবে। এসব গুজবের দরুন ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ও মাঝেমাঝে সহিংসতা উস্কে দেয়।

উপরোক্ত পদক্ষেপ বাংলাদেশের সংবিধান ও এ সম্পর্কিত রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ আইন, আঞ্চলিক পরিষদ আইনের অন্যান্য ধারা মোতাবেক সমান অধিকার ও বৈষম্যহীনতার মাধ্যমে নিতে হবে। জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতা হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য যেসব স্থানে, যেমন, ভারত, যুক্তরাজ্য, পূর্ব ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র, সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সেসব দেশে একটি নির্দিষ্ট জাতির পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয় না, বরং বহু জাতির ও বর্নের বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

রাঙ্গামাটিতে জাতিগত সহিংসতা ও উত্তেজনার ইতিহাস

জাতিগত কারণে আদিবাসী ও বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের মধ্যে রাঙ্গামাটি শহরে উত্তেজনা ও সহিংসতার ঘটনা অনেক বছর ধরে ঘটে আসছে। বিশেষ করে ১৯৯০ থেকে। যদিও প্রতিটি ঘটনার নিজস্ব বৈষিষ্ট্য ও বিষয়বস্তু রয়েছে, তবে এর বাইরেও কিছু মিলও রয়েছে ঘটনাগুলোর মধ্যে। যার ফলে কিছু জিনিস বোঝা যায়। ১৯৯২ সালের ২০ মে ও ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংঘটিত ঘটনাসমূহ ও আরও অনেক নিম্নমানের সহিংস ও উত্তেজক ঘটনা এর অন্তর্ভূক্ত। উপরোক্ত ঘটনার যদি যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে তা রাঙ্গামাটি শহরে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতো। একই সঙ্গে তা রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনকে পরিস্থিতি সামাল দিতে সাহায্য করতো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য তদন্ত কমিশিন, যেমন, ২০১২ সালের সেপ্টম্বর রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত ঘটনার জন্য গঠিত তদন্ত কমিশন যা রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক গঠন করেছিলেন, তা মেধাহীনদের দিয়ে গঠন করা না হলেও, যথেষ্ট ক্ষমতাশীল ছিল না, স্বাধীন ছিল না। ফলে যথেষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা এ ধরণের জটিল ইস্যু মোকাবেলায় গ্রহন করা যায়নি, সুপারিশও করা হয়নি।

এটা আসলেই আফসোসের বিষয় যে একই ধরণের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৯২ সালের ২০ মে ও ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংঘটিত ঘটনা, যা স্বচ্ছ, স্বাধীন ও বৈষম্যহীনভাবে মোকাবেলা করা হয়নি, কার্যকরভাবেও হয়নি। এগুলোর কিছু বিষয় তৎকালীন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের নজরে আনা হয়েছিল ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে এ সংশ্লিষ্ট সভায়। নির্দিষ্ট করে বললে, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের হামলার সময় অবৈধ কার্যকলাপকারীদের রাঙ্গামাটির অনেক বাসিন্দা দেখেছেন প্রকাশ্যে দিবালোকে আইন ভঙ্গ করতে, যা বাংলাদেশ পেনাল কোডের বেশ কয়েকটি ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন। দাঙ্গা, অগ্নিকাণ্ড, অপরাধের ষড়যন্ত্র, পৃষ্ঠপোষকতা, অবৈধ সমাবেশ, অবৈধ সমাবেশকারীদের দ্বারা জমি দখল, অবৈধভাবে মানুষ জড়ো করা, ইত্যাদি। এদের খুব কম সংখ্যক্কেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর কারণ সাধারণ মানুষের জানা নেই।

পাহাড়ি-বাঙ্গালি শান্তিপূর্ন জোট

রাঙ্গামাটিতে গত সপ্তাহ ধরে সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো ঘটার পরও, পাহাড়ি বাঙ্গালির পারস্পরিক সহযোগীতার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এর ফলে অনেক ভিত্তিহীন গুজব, উত্তেজনা ও সহিংসতা কমাতে সাহায্য করেছে। কিছু ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ন ও আইন মান্যকারী এক জাতির মানুষকে অন্য জাতির বা ধর্মের মানুষ আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে। রাঙ্গামাটিতে শহরে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ, পাহাড়ি বা বাঙ্গালি, হচ্ছেন আইনমান্যকারী, শান্তিপ্রিয়। সরকার আত্মবিশ্বাসের সাথে সকল জাতি ও ধর্মের মানুষের সহায়তার মাধ্যমে জাতিগত দাঙ্গার বিষয়ে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারে। যা হবে এ ধরণের ঘটনার ইতিহাস ধর্তব্যের মধ্যে রেখে এবং সঠিক, বৈষম্যহীন ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।

নিম্নস্বাক্ষরকারী জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে সম্পূর্ন সহায়তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করছে।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 11,177 বার পঠিত হয়েছে


Subscribe to Comments RSS Feed in this post

2 Responses

  1. Pingback: মানছুরুল হায়দার

  2. Pingback: Tripan Chakma

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen