ফিরোজা বেগম চিনু ৩ পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে তার আর্দশে অনুপ্রানিত হয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছেন। তিনি জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি তখন ক্লাশ ফাইভে পড়তাম, সে সময় বঙ্গবন্ধু একবার রাঙামাটি এসেছিলেন আমি ছোট থাকায় আমাকে ফুলের তোড়া দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে দেয়ার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুকে ফুল দেয়ার পর আমি এত আনন্দিত হয়েছিলাম যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। যেদিন বঙ্গবন্ধু মারা যান তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমি এইচএসসি ভর্তি হই রাঙামাটি সরকারী কলেজে। কুমিল্লা থেকে ডিগ্রী পাশ করি। আমি যখন বিয়ের পর কুমিল্লায় যাই তখন আমার শ্বাশুরী আমাকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আমি যখন রাঙামাটি স্থায়ীভাবে চলে আসি তখন এরশাদের আমলে রাঙামাটি জেলা আওয়ামালীগের সভাপতি বদিউল আলম ওয়ার্ড সভাপতি করার মাধ্যমে আমাকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। পরে বর্তমান সভাপতি দীপংকর তালুকদার জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব নেবার পর আমাকে জেলা আওয়ামীলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাকের দায়িত্ব দেন এর পর আমি মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে যে পথ চলা শুরু করেছি এখন বর্তমানে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য হিসেবে সে পথ চলা আর থেমে থাকেনি। সম্প্রতি তার বাসভবনে সিএইচটি টুডে ডট কম টীমের সদস্যরা পাহাড়ের নানা বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা।
প্রশ্ন: স্বাধীনতার ৪২ বছর পর রাঙামাটির মানুষ একজন মহিলা বাঙ্গালী সংসদ সদস্য পেল বিষয়টি কেমন লাগছে?
অভিমত: রাঙামাটিতে দীর্ঘদিন পরে একজন মহিলার সংসদ সদস্য পেয়েছে এটা রাঙামাটিবাসীর জন্য গর্বের ব্যাপার। আমি পাহাড়ী বাঙ্গালী সেই বিভাজনে যাব না, আমি মনে করছি এই পার্বত্য অঞ্চলে রাজনীতি করেছি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পাহাড়ী বাঙ্গালী এবং নারীদের জন্য কাজ করেছি। পাহাড়ের মহিলাদের রাজনীতিতে আনিয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে, সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, বর্তমান পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এবং কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাসহ দলের সকল স্তরের নেতা কর্মীদের সহযোগিতা এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার মুল্যায়নের কারনে আমি সংসদ সদস্য হয়েছি। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: পার্বত্য জেলার একমাত্র নারী সংসদ সদস্য হিসেবে আপনার কমিটমেন্ট কি? গত এক বছরে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
অভিমত: আমি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহনের পর আমি পার্বত্যবাসীর বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছি আমি এর বাইরে যাই নাই। আমি সংসদে পাহাড়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন অপহরন বন্ধের দাবী জানিয়েছি, আমি বলেছি এখানকার মেয়েরা অবহেলিত, তাদের বিয়ে রেজিষ্ট্রি হয় না, বিশেষ করে অউপজাতীয় মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পায় না, এখানকার মেয়েরা পিছিয়ে রয়েছে তাদের আত্ব কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আগামী ১ বছরের জন্য আমি কতুকছড়িতে জিআর, টিআর, কাবিখা এর মাধ্যমে ৪টি সোলার প্যানেলের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। আপনারা জেনে খুশি হবেন ফিশারি বাধ হওয়ার পর এটি সংস্কার হয়নি বাঁধটি এখন হুমকির সম্মুখীন। আমি পানি সম্পদমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি ডিও লেটার দিয়েছি উনি কথা দিয়েছি এটি করে দিবেন। যেখানে বসার জায়গা থাকবে, স্পিল ওয়ে থাকবে বাঁধটি হবে দৃষ্টি নন্দন। এছাড়া রাঙামাটিবাসীর চাহিদা অনুযায়ী যখন যেখানে যা দরকার আমার সহযোগিতা থাকবে।
প্রশ্ন: নারী সাংসদদের এলাকার উন্নয়নে যে পরিমান বরাদ্দ দেয়া হয় সেটি কি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন?
অভিমত: একেবারেই বরাদ্দ অপ্রতুল। আমাদের নির্বাচিত জন প্রতিনিধি যদি ৩ টাকা পান সেখানে আমি পাই ১টাকা। পিছিয়ে পড়া নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে ছোট বরাদ্দ তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। আমি বিভিন্ন সভা সেমিনারে বলেছি এর পরিবর্তন হওয়া দরকার। উদাহরন স্বরুপ বলতে পারি সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয় থেকে পুরুষ সদস্য পেয়েছেন ২০টি সেলাই মেশিন আর মহিলা সংসদ সদস্যকে ৫টি সেলাইমেশিন দেয়া হয়েছে। এটি এক ধরনের বৈষম্যে। আমি সরকারের কাছে আবেদন করব নারী পুরুষের এই বিশাল বৈষম্যে দুর করা উচিত। প্রয়োজনে সংরক্ষিত আসনগুলোতে নির্বাচন করা যেতে পারে। আমার ইচ্ছা আছে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর মাধ্যমে নারীর উন্নয়নে কিছু করার।
প্রশ্ন: গত ৫ জানুয়ারীর সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনে আপনারা হেরে গেছেন এর কারন কি?
অভিমত: রাঙামাটির প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন ছিল, আপনারা সকলেই জানেন রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভোটারদেরকে ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয়নি নিজেদের ইচ্ছামত সিল মেরে ব্যালেট বাক্স ভর্তি করেছে এটা অলিখিত সত্য, এক ধরনের ওপেন সিক্রেট আমরা আমাদের গনতান্ত্রিক ভোটারধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি আমরা হেরে যায়নি আমাদের হারানো হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার দলের অনেক নেতা দাবী করেছেন অবৈধ অস্ত্রধারীরা মানুষকে জিম্মি করে রাখায় আপনার দল হেরে গেছে তাই যদি অবৈধ অস্ত্রধারী ও চাদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন?
অভিমত: অবৈধ অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এটা ঠিক না, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঙ্গিকে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্র্র্র্র্রনালয়কে জানিয়েছি। আমি সংসদে বলেছি আমাদের সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার সংসদে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, খুন, অপহরন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবী জানিয়েছেন। আমরা আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে চাঁদাবাজি বন্ধে।
প্রশ্ন: পাহাড়ী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সর্ম্পকের উন্নয়নে কি পদক্ষেপ নিবেন?
অভিমত: আমি সর্বপ্রথম চাই আমরা পাহাড়ী বাঙ্গালী যারা বসবাস করছি তাদের মধ্যে সুসর্ম্পক গড়ে উঠুক। বিশ্বাস ও আস্থা সব সময় থাকুক। সুর্ম্পক উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। জেএসএস নির্বাচনের সময় আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মাঠে সশস্ত্র অবস্থান নিলেও বিজুর দিন তার বাসায় গিয়েছিলাম। আমি উষাতন তালুকদারকে বলেছি আমার সাথে আপনার মতাদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে, রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে যেটা রাস্তা, মাঠে ঘাটে । কিন্তু আমাদের ব্যাক্তিগত সর্ম্পক থাকবে ভালো নিবিড়। আসলে এই জিনিসটা সকলের বোঝা উচিত আমি বিশেষ করে নিরীহ পাহাড়ীদের কথা বলব তাদের ভুল বোঝানো হচ্ছে একবার বলা হচ্ছে সরকার তাদের বাঙ্গালী বানিয়ে ফেলছে এ কথা বলে বাঙ্গালীদের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, আন্দোলন করানো হচ্ছে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে। এসব করে তাদের সাথে আমাদের দুরত্ব বাড়ানো হচ্ছে। আমরা সেটা চাই না সরকার পাহাড়ে উন্নয়নের জন্য কাজ করছে পাহাড়ী বাঙ্গালী সকলের জন্য আমরা পাহাড়ী বাঙ্গালী বিভাজন চাই না। কারন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এখানে সবাই তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা, সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করবে।
প্রশ্ন: সরকারের এ মেয়াদে আপনারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কি পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন?
অভিমত: শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন একটা চলমান প্রক্রিয়া , চুক্তির সিংহভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে আমার কষ্ট আমরা যাদের সাথে চুক্তি করেছি তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি আমরা চুক্তি অনুযায়ী মাধ্যমিক এবং পর্যটন জেলা পরিষদ ন্যস্ত করেছি। এই দুইটা অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত দেয়া সত্বেও তারা একটা অনুষ্ঠানেও আসেননি এটা দু:খজনক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক। তারা যদি সত্যিকারর্থে চুক্তি বাস্তবায়ন চায় তাহলে তাদের উচিত সরকারের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কিভাবে করলে চুক্তিটা আর ফলপ্রুস হবে সে বিষয়ে সহায়তা করা কিন্তু সেটা তারা করছে না। তবে আমার নেত্রী চুক্তি বাস্তবায়নে ওয়াদাবদ্ধ তিনি চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন।
প্রশ্ন: জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বাতিল, জেলা পরিষদ আইন সংশোধনী বাতিলের দাবী জানিয়ে ভোটার তালিকা প্রনয়নের মাধ্যমে নির্বাচনের দাবী জানিয়েছে বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন?
অভিমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বাতিলের জন্য তারা যে দাবী করেছেন সেখানে বলতে হয়, সংসদে আমরা বিলটি উপস্থাপনের পর যখন স্থায়ী কমিটিতে গেল তখন ৩ সদস্য বিশিষ্ট সাব কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটিতে সুবিদ আলী ভুইয়া, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবং উষাতন তালুকদার ছিলেন। ৩ জনকে সমন্বয় করে সাব কমিটি গঠন করা হয়েছিল যাতে চুক্তির কোথাও ভুল ভ্রান্তি আছে কিনা তা পরীক্ষা নিরাক্ষা করার জন্য। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর উনারা ৩জনই স্বাক্ষর করে বিলটি জমা দিয়েছেন। বিলটি উপস্থাপনের পর আমরা সংসদে পাশ করেছি। অথচ সাব কমিটির মেম্বার উষাতন তালুকদার রাঙামাটিতে সংবাদ সম্মেলন করে এর বিরোধীতা করেছেন। উনি ঢাকায় এক ধরনের কথা বলেছেন আর রাঙামাটিতে এসে নিরীহ জনগনকে এক ধরনের কথা বলা এটা পাহাড়ী বাঙ্গালী সর্ম্পকের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। আমরা যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছি আমরা নিরীহ সহজ সরল, মানুষকে ঢাকায় এক ধরনের কথা বলা আবার রাঙামাটিতে এসে আরেক ধরনের কথা বলি এটা সর্ম্পক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। এসব দ্বিমুখী কথা বার্তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আমি অনুরোধ উনারা যেন এই কাজটা না করেন । পাহাড়ী বাঙ্গালী সর্ম্পক উন্নয়নে কাজ করেন।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে জনসংহতি সমিতি মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতা করেছে যদিও সরকার ইতিমধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে কিন্তু জায়গা নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে সব বাধা বিপত্তি পিরিয়ে কি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কাঙ্খিত পথে চলতে পারবে?
অভিমত: প্রধানমন্ত্রী যখন চেয়েছেন, এলাকাবাসীর যখন দাবী তখন রাঙামাটিতে সকল বাধা বিপত্তি পিরিয়ে মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবেই। যারা বিরোধীতা করছেন তাদের বলব এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনার আমার সন্তানেরা লেখা পড়া করবে। আপনারা এটি বাধা না দিয়ে এটা আরো কিভাবে সুন্দর হবে, ভালো হবে সে বিষয়ে সহায়তা করেন। আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের কিছু রেখে যাওয়া দরকার। আর বলতে হয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন তখন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবেই। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মত কঠিন কাজ এবং যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্য করার মত কঠিন কাজ যখন বাংলার মাটিতে বাস্তবায়ন হয়েছে তখন মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কাজ করা তেমন কোন বিষয় না। তবে আমাদের কোন সমস্যা থাকলে এটি আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা উচিত।
প্রশ্ন: পাহাড়ে নব গঠিত ভুমি কমিশন ভুমি সমস্যা সমাধানে কতটুকু কার্যকর ভুমিকা নিতে পারবে ?
অভিমত: আমরা আশা বাদী চুক্তি যাদের সাথে করা হয়েছে তারা যদি আন্তরিক হোন তাহলে ভুমি কমিশন কার্যকর ভুমিকা নিতে পারবে। চুক্তির পর থেকে আমরা যে কয়বার কমিটি গঠন করেছি, তাতে চুক্তি পক্ষ কমিশন সভায় উপস্থিত হননি। ভুমি কমিশনের কার্যক্রমে যদি কারো আপত্তি বা দ্বিমত থাকে তাহলে সেটি কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে হবে। মানি না মানব বলে যদি আমি কমিশন সভায় না যাই তাহলে সমস্যার সমাধান হবে কি করে?