উষাতন তালুকদার এমপি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রজীবনে মাধ্যমিকে পদার্পণের প্রারম্ভেই শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কাউটিং-এ জড়িত ছিলেন। পরে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে শাহ উচ্চ বিদ্যালয় হতে স্কাউট লিডার মনোনিত হয়ে করাচী জাম্বুরীতে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। অধ্যয়নরত অবস্থায় ইন্টারমিডিয়েট থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাজনীতি বিজ্ঞান) বিএ অনার্স সম্পন্ন হয়। অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে টঙঞঈ (UOTC (University Officer Training Corps)) এ অংশ নিই। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও দীর্ঘ সময় ধরে একনিষ্ঠ কর্মী এবং সংগঠক হিসেবে জড়িত ছিলেন। উষাতন তালুকদার ৬৯-এর গণআন্দোলনে, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, তিনি জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি। উষাতন তালুকদার ১৯৯৭ সনের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তির আলোকে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে এ বছরের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা বিষয়ে পাহাড়ের জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক সিএইচটি টুডে ডট কম এর টীমের সাথে আমাদের খোলামেলা কথা হয়। তার সাক্ষাতকারটি হুবহু পাঠকদের জন্য তোলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: কেমন আছেন?
অভিমত: ভালো আছি। কিন্তু কর্ম ব্যস্ততা তো রয়েছেই।
প্রশ্ন: এমএন লারমার পর আপনিই জনসংহতি সমিতি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কেমন লাগছে?
অভিমত: ভালো। তবে খুব জটিল, প্রতিকূলতা এবং চ্যালেঞ্জিং ………… !
প্রশ্ন: একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল থেকে আপনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত, আপনার উন্নয়ন ভাবনা কি? গত এক বছরে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
অভিমত: শুধু দল কেন, এই এলাকার শান্তিকামী সর্বস্তরের আপামর জনতাই আমাকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। সকল জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টায় আছি। বিশেষ করে পশ্চাৎপদ এলাকাগুলোতে সেখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: পাহাড়ী বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে কি পদক্ষেপ নিবেন?
অভিমত: এ পদক্ষেপ শান্তি ও প্রগতি প্রত্যাশী গণমানুষের কিংবা এখানে যাঁরা বাস করছি তাদের সবার। জনপ্রতিনিধি তার উপলক্ষ মাত্র। এ ব্যাপারে অত্রাঞ্চলের পাহাড়ী বাঙালীসহ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দেশের অপরাপর বিভিন্ন মহলের পারস্পরিক সহযোগিতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, বিশ্বাস, আন্তরিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব/দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: সাংসদ হিসেবে সংসদে এবং সংসদের বাইরে এলাকার উন্নয়নে আপনার ভূমিকা কি হবে?
অভিমত: তৃণমূল পর্যায়ে বসবাসকারী পশ্চাৎপদ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্খা, তাদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির যতটুকু অধিকার রয়েছে সেই অবস্থান থেকে শুধু সংসদে কেন সংসদের বাইরেও বিভিন্ন দপ্তর কিংবা প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নের কথা তুলে ধরার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
প্রশ্ন: পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নে আপনার পরিকল্পনা কি?
অভিমত: শুধু উন্নয়ন নয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মাদকমুক্ত রাঙামাটি গড়ার ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করি।
প্রশ্ন: গত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আপনি একজন হেভিয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, এর পেছনে গোপন রহস্য কি? কোন কৌশল অবলম্বন করেছিলেন?
অভিমত: গোপন রহস্য কিংবা কৌশল বলতে কিছুই নেই। এ বিজয় এলাকার সর্বস্তরের গণমানূষের যাঁদের অনুপ্রেরণা, অকুন্ঠ ভালবাসা ও সমর্থন না পেলে আমি সত্যিই এ দুর্লভ জায়গায় আসতে পারতাম না। তাই শান্তি পিয়াসী জনতার এই ঋণ, এই অবদান, এই স্বীকৃতি কোনো দিন শোধ করার নয়। এ জন্য আমি তাঁদের সবার কাছে চিরকৃতজ্ঞ, দোয়া ও আশীর্বাদ প্রার্থী।
প্রশ্ন: বিজিত প্রার্থীর দাবি আপনার দলের অস্ত্রধারীরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ভোট আদায় করেছে তাই প্রতিপক্ষ হেরে গেছে- এটা আসলে কতটুকু সত্য?
অভিমত: এটি একটি ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্য প্রণোদিত মন্তব্য। নিজের ব্যর্থ দুর্বলতা ঢাকার অপপ্রয়াস ছাড়া কীই বা হতে পারে। তবে উপদেশ নয়, অনুরোধ করছি গণমানুষের আত্মবিশ্বাসের জায়গায় আরো শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক হতে। কারণ জনতাই হচ্ছে মূল বিচারক।
প্রশ্ন: বর্তমান সরকারের কিছুদিন পর এক বছর পূর্ণ হবে। গত এক বছরে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের কোন আন্তরিকতা লক্ষ্য করেছেন? সংসদীয় কমিটির সভায় চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কি আলাপ হয়েছে?
অভিমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে এখনও সরকারের সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি তথা সরকারের কাছে এটুকুই বিশ্বাস, প্রত্যাশা এবং দাবি থাকবে যে, অনতি বিলম্বে রোডম্যাপ আকারে এ মুহুর্ত থেকে যত দ্রুত সম্ভব পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
প্রশ্ন: পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত কেন? এই সংঘাতের ফলে আহত নিহত হচ্ছে। সংঘাত উত্তরণে আপনারা কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন কিনা?
অভিমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলেই সাধারণ জনমনে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ, অবিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক। এ দ্বিধা, অবিশ্বাস, সন্দেহ একমাত্র সরকারই দূর করতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই সকল সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায়। এর বিকল্প কোনো কিছুই নেই এবং হতেই পারে না!
প্রশ্ন: জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বাতিল, জেলা পরিষদ আইন সংশোধনী বাতিলের দাবি জানিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে এর কারণ কি?
অভিমত: এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন/সংস্থার পক্ষ থেকে এখানকার মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনায় এনে কিছু অসংগতি বিষয় যা পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের স্বার্থের পরিপন্থি, সেসব বিষয়ের আলোকে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েক দফা দাবিনামা সংশোধনী আকারে এনে সরকারে কাছে উত্থাপন ও পেশ করা হয়। উল্লেখ্য যে পার্বত্য চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ভ’মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের কাছে সংশোধনী আকারে তুলে ধরা হয়েছে। তবে ভ’মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ব্যতিরেকে বাদবাকী বিষয়গুলো সরকার মনগড়াভাবে এগুচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে যা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। জনগণ এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে
পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করাই সরকার তথা দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে জনসংহতি সমিতি মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতা করেছে যদিও সরকার ইতিমধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে কোন কারণে আপনারা এর বিরোধীতা করছেন। এর স্বপক্ষে আপনাদের যৌক্তিকতা কি?
অভিমত: এ অঞ্চলে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি এত জরুরী ও মূখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের ন্যায্য অধিকার ও বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণসহ এখানকার সার্বিক প্রেক্ষাপট, রীতিনীতি, প্রথাগত ঐতিহ্য, পদ্ধতি, কৃষ্টি সংস্কৃতি প্রভৃতি বিবেচনায় এনে সর্বপ্রথমেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা সরকারের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
প্রশ্ন: পার্বত্য ভূমি কমিশন সরকার পুনরায় গঠন করেছে, আপনার কি মনে হয় এই কমিশন ভূমি সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে?
অভিমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (ঘ) খন্ডের ২নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে- ‘‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতঃ উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চুড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’’
অতি সাম্প্রতিককালে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান শ্রী, জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার সাথে ভ’মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন নিয়ে অতি গুরুত্ব সহকারে আলাপ আলোচনা করেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসণীয়। এ আলোচনা ইতিবাচকের মধ্য দিয়েই অতি দ্রুত একটা সমাধানের পথে এগুবে বলে আশা করা যেতে পারে। ঠিক তদ্রুপ আর সামান্যতম কালক্ষেপন না করে যত দ্রুত সম্ভব পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো সমাধানের উদ্যোগ সরকার আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সহিত গ্রহণ করবে এলাকার গণমানুষের পক্ষে আমি এ প্রত্যাশা করলাম।
প্রশ্ন: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অভিমত: আপনাদেরও ধন্যবাদ।