শিরোনামঃ

আইসিডিপি’র প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা

মায়ের ভাষায় শিখছে পাহাড়ের শিশুরা

সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। পাড়াকেন্দ্রের আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী শিশুদের বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী সার্বিক বিকাশে সহায়তা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনের জন্য প্রস্ত্ততিমূলক এই শিক্ষা কার্যক্রমে একটি sam_9737নতুন মাত্রা যোগ করা হয়েছে। এটি হলো ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা’। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের বসবাস যাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাষা রয়েছে। যেখানে এক ভাষার সাথে অন্য ভাষার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না এবং অধিকাংশ শিশুর মাতৃভাষা বাংলা নয়। পাড়াকেন্দ্রে আসা শুরু করার সময় তাদের তেমন বাংলা জ্ঞান থাকে না এসব বিবেচনায় দীর্ঘদিন ধরে পাড়াকেন্দ্রে শিশুদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অনির্দেশিতভাবে মাতৃভাষার প্রচলন ছিল। শিশু শিক্ষায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার পার্বত্য চট্টগ্রামের শিশুদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং শিশুরা পাড়াকেন্দ্রের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এ কারনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষার কৌশল’ গ্রহন করা হয়েছে।

 

যদিও পাড়াকেন্দ্রে মাতৃভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু তা ছিল কেবল শিশুর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই। ২০১৪ সালে পরিকল্পিতভাবেই ২০৮টি পাড়াকেন্দ্রে ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা’ চালু করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলার ৪০০০ পাড়াকেন্দ্রের ৫৫০০০ শিশু মায়ের ভাষায় শেখার সুযোগ পাচ্ছে। যেখানে শিশুরা মাতৃভাষায় ছড়া শিখে, গান গায়, গল্প বলে, নিজেদের প্রকাশ করে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বাংলার সাথে যোগাযোগ ঘটে। প্রাথমিকভাবে বান্দরবান সদর উপজেলা, রুমা, রোয়াংছড়ি এবং থানচি এই চার উপজেলার ম্রো, ত্রিপুরা এবং মারমা তিন সম্প্রদায়ভুক্ত পাড়াকেন্দ্র সমূহে এই কার্যক্রম চালু করা হলেও বর্তমানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের শিশুরাও মাতৃভাষায় শিখছে।

 

এই কৌশলে শিশুরা যখন প্রথম পাড়াকেন্দ্রে আসে, তখন তাদের সাথে যোগাযোগের কাজটা সর্ম্পূন তাদের মাতৃভাষাতেই করা হয়। মাতৃভাষাতেই শিক্ষক তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন এবং শিশুরাও মূলত নিজেদের মাতৃভাষাতেই কথা বলে, ছড়া বলে, গান গায় এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে। এভাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার সাথে পরিচয় ঘটে। বাংলা বর্ণ, ছোট ছোট শব্দ ও বাক্য চিনতে ও পড়তে পারে, তারা বাংলায় কথোপথন করতে শিখে, নির্দেশনা দিতে ও বুঝতে পারে, ছড়া বলে, গান গায় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষা গ্রহনের জন্য প্রস্ত্তত হয়।

 

‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষার কৌশল’ এর মাধ্যমে শিশুরা যে নিজের ভাষায় লিখতে পড়তে শিখবে তেমনটা নয়। মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহারও এর আওতায় পড়ে আর এটিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীর শিশুরা ধীরে ধীরে বাংলা শিখবে পরবর্তীতে ইংরেজী ভাষাও শিখবে এভাবে পর্যায়ক্রমে একাধিক ভাষার সমন্বয়ে শিক্ষার কৌশল ‘ Mother Tongue Based Multilingual Education (MLE) বা মাতৃভাষা ভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা’-কে শিশুদের শেখার ভিত্তি রচনার কাজে লাগানো হচ্ছে। স্থানীয় ভাষায় শিশুতোষ ছড়া, গান, গল্প ছাত্রছাত্রীদের শেখানো ছাড়াও পরিবার, সমাজ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক পাঠদান স্ব স্ব মাতৃভাষায় শেখানো হচ্ছে।

 

 

পাড়াকেন্দ্রে MLE কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য পাড়াকর্মী, সিনিয়র পাড়াকর্মী ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে। এ জন্যে ইউনিসেফ এর সহায়তায় তৈরী করা হয়েছে নতুন প্রশিক্ষন মডিউল ও পাড়াকর্মী সহায়িকা। ৪০০০ পাড়াকর্মীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নতুন এ সহায়িকা। নতুন পাড়াকর্মী সহায়িকা হাতে পেয়ে পাড়াকর্মীদের মধ্যে ফিরে এসেছে উদ্দীপনা। জুড়াছড়ি উপজেলার লক্ষি মেম্বার পাড়া পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মী ননাবি চাকমা জানান, মাতৃভাষায় শেখার কারনে শিশুদের শেখার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বেড়েছে। তারা সহজে যে কোন কিছু বুঝতে পারে।  নিজের ভাষায় গান, গল্প, ছড়া শুনতে ও বলতে পেরে আনন্দ লাভ করে।

 

আইসিডিপি পাড়াকেন্দ্রে মাতৃভাষা ভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিষয়ে বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক ও গবেষক ড: প্রশান্ত ত্রিপুরা পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। আইসিডিপি এর MLE কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার চাহিদা পূরণ, বিলুপ্ত প্রায় ভাষা সংরক্ষন, প্রাথমিক শিক্ষার পরিপূর্ণ প্রস্ত্ততি, প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ঝড়ে পড়া রোধের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।

Print Friendly, PDF & Email

Share This:

খবরটি 565 বার পঠিত হয়েছে


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*

Time limit is exhausted. Please reload CAPTCHA.

ChtToday DOT COMschliessen
oeffnen