মং ওয়াই মার্মা, সিএইচটি টুডে ডট কম,। ওয়াগেই পোয়ে (প্রবারনা পুর্নিমা) মারমা আদিবাসীদের অন্যতম ধর্মীয় ভাবে উৎসবের দিন। দীর্ঘ তিনমাস বৌদ্ধ ভিক্ষু বর্ষাবাস পর এই দিনে পালিত হতে যাচ্ছে। এই উৎসবে সব চেয়ে বেশী আকর্শন হল ফানুশ উড়ানো আর মন্দিরে মন্দিরে আহার বিতরন। পুর্নিমার দিনের শুরুতে মন্দিরে চলে শীল গ্রহন, ছোঁয়াই বা পিণ্ড দান। অন্যান্য উৎসবের মত একের অন্যের বাড়িতে ভ্রমন আর আপ্যায়নেরকিন্তু কমতি নেই। অনেক মারমা আদিবাসীদের গ্রাম কিছু দূরে অবস্থান করাতে হয়ত এক দিনে আহার দান অনুষ্ঠিত হয়না। যেদিন যেখানে হবে ঠিক সেইদিন জমে উঠে নতুন করে এই উৎসব। বিকাল বেলা চলে সকল বয়সের জন্য শীল গ্রহন, মেডিটেশন, দান ও বিবিদ কাজ। সন্ধ্যা হলেই আকাশে ফানুশ উড়ানো হয়। রাতের বেলা চলে পিঠা উৎসব।
প্রবারনা উদযাপনের বিধান প্রবর্তনের ইতিহাস :বুদ্ধ তখন শ্রাবস্তীর আনাথপিন্ডিক নির্মিত জেতবন আরামে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় কোশল জনপদের এক বিহারে বহু সংখ্যক ভান্তে বা ভিক্ষু অবস্থান করছিলেন। তারা ছিলেন প্রগাঢ় মিত্রভাবাপন্ন। কিন্তু তারা ছিলেন সন্দৃষ্ট, মানে চোখে দেখা হলেও আলাপচারিতা হত না। তাঁরা বর্ষাবাস শেষে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বুদ্ধকে দর্শন ও বন্দনা করার জন্য শ্রাবস্তীতে উপনীত হলেন। বুদ্ধ বন্দনা শেষে একান্তে উপবেশন করলে বুদ্ধ তাঁদের নির্দেশ দিলেন ‘ হে ভিক্ষুগণ ! আমি অনুজ্ঞা প্রদান করছি- বর্ষাবাসকারী ভিক্ষুগণ দৃষ্ট, শ্রুত কিংবা আশঙ্কিত ত্রুটি বিষয়ে প্রবারনা করবে। এতে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে অনুকূলতা, অপরাধ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় ও নিয়মানুবর্তিতা আনয়ন করবে। দক্ষ ও সমর্থ ভিক্ষু সংঘকে এভাবে জ্ঞাপন করবে, মাননীয় সংঘ, আমার প্রস্তাব শ্রবন করুন। অদ্য প্রবারণা, সংঘ যদি সমীচীন মনে করেন তাহলে সংঘ প্রবারণা করতে পারেন। ’ প্রবারণার দিক নির্দেশনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন “ স্থবির ভিক্ষু উত্তরাসঙ্গ দ¦ারা দেহের একাংশ আবৃত করে পায়ের অগ্রভাগ দিয়ে উৎকুটিত হয়ে বসে করজোড়ে বলবেন, আয়ুস্মানগন! দৃষ্ট ,শ্রুত বা আশঙ্কিত- আমার এরুপ কোনো ত্রুটি থাকলে তা অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন। নিজের মধ্যে কথিত ত্রুটি দেখলে আমি তা প্রতিকার করব। এভাবে তিনবার বলবেন। এ নিয়মে কনিষ্ঠানুক্রমে অপরাপর ভিক্ষুগণও প্রবারনা করবেন। প্রবারনা সংঘ ছাড়াও চার, তিন, দুই কিংবা একজন ভিক্ষুও করতে পারেন।’
প্রবারনার আরও বিভিন্ন নিয়ম ‘মহাবগ্গ’ নামক বিনয় পিটকে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ হয়েছে। সেই থেকে প্রবারনা বা আশ্বিনী পূর্নিমা বৌদ্ধদের নিকট অতি পবিত্র পর্ব হিসেবে পরিচিত।
এ দিনে ভগবান বুদ্ধ সারনাথে তিনমাস বর্ষাবাস শেষে ষাটজন অর্হৎ ভিক্ষুকে আহ্বান করে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘ হে ভিক্ষুগণ! তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর, বহুজনের হিতের জন্য , জগতের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেবতা ও মানুষের অর্থ হিতের জন্য। কিন্তু দুজন একপথে যেয়ো না। হে ভিক্ষুগণ, তোমরা ধর্ম দেশনা করো, যার আদিতে কল্যান, ,মধ্যে কল্যান এবং অন্তে কল্যান এবং অর্থযুক্ত , ব্যঞ্জনযুক্ত, সমগ্র পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করো ’ ( মহাবর্গ)।
মহাবর্গে উল্লেখ আছে, বুদ্ধ এদিন থেকেই তাঁর ধর্ম বাণী সাধারণের কল্যানে প্রচার শুরু করেছিলেন। তথাগত বুদ্ধ তাঁর মাতৃদেবী মহামায়াকে তিনমাস ধর্মদেশনা করে এদিনে তাবতিংস স্বর্গ হতে সাংকাশ্য নগরে অবতরন করেছিলেন। তিনি এদিন বহুবিধ অলৌকিক ঋদ্ধি প্রদর্শন করেছিলেন। সেই দিনও ছিল আশ্বিনী পূর্ণিমা। এ দিনটি বৌদ্ধরা বেশ ঝাঁকজমকভাবে উদযাপন করে।
প্রবারনা মূলত ভিক্ষুসংঘের বিনয়- সম্পর্কিত অনুষ্ঠান হলেও গৃহী বৌদ্ধরাও এটাকে শ্রদ্ধা ও সাড়ম্বরে প্রতিপালন করে। প্রবারনার দিনে প্রত্যুষে নতুন ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে নানা প্রকার খাদ্য-ভোজ্য , ফলমূল, দীপ-ধূপ, পুষ্পাদি নিয়ে স্থানীয় বিহারে গমন করে। তারা সম্মিলিতভাবে বুদ্ধ পূজা , উপাসনা ও শীল গ্রহন করে। যাদেও পক্ষে সম্ভব তারা উপোসথ শীল পালন করে ও অন্যরা পঞ্চশীল গ্রহন করে। এদিনে প্রবারনার তাৎপর্যসহ বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ওপর ভিক্ষুসংঘ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ আলোচনা করেন।