সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। রাঙামাটি ২৯৯নং আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা উষাতন তালুকদার মঙ্গলবার রাতে এক জরুরী সংবাদ সম্মেলনে সংসদে উপস্থাপিত পার্বত্য জেলা পরিষদ সংশোধনী বিল ২০১৪ স্থগিত করার দাবী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা তৃতীয় কোন পক্ষ ছাড়াই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম। চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের সাথে আলাপ আলোচনা করে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা থাকলেও পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও সচিব নিজেদের নিজেদের ইচ্ছা মাফিক কোন আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদে বিল উপস্থাপন করেছেন যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুস্পষ্ট লংঘন।
তিনি আরো বলেন, একতরফা ভাবে ৫ সদস্যর স্থলে ১১ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংসদে উপস্থাপনের পুর্বে কারো সাথে আলোচনা করা হয়নি। এই বিলের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতি ফলন ঘটেনি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি বিলটি স্থগিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি আর্কষন করে বলেন, আমরা শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আশ্বাস বিশ্বাস রেখে চুক্তি করেছিলাম তেমনি আমাদের দাবীর প্রতি সরকার শ্রদ্ধাশীল হবে বলে আমরা আশা রাখি। তিনি চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রনয়নের মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন দাবী করেন।
সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং, জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা ও জনসংহতি সমিতির রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত: পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর অর্ন্তবর্তীকালীন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য সংখ্যা ৫ এর স্থলে ১১জন করার জন্য মন্ত্রীসভা গত ১০ মার্চ অনুমোদন দেয়। গত ২৬ জুন পার্বত্য জেলা পরিষদ সংশোধনী বিল সংসদে উপস্থাপনের পর আজ ১ লা জুলাই এটি যাচাই বাছাইয়ের জন্য স্থায়ী কমিটিতে প্রেরন করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তি অনুযায়ী জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন দাবী করে দেয়া হুবহু বিবৃতি:
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে অন্তর্বর্তী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আকার ৫ সদস্য থেকে ১১ সদস্যে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ‘রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৪’, ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৪’ এবং ‘বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৪’ নামে তিনটি বিল গত ২৬ জুন ২০১৪ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। উক্ত বিলের উদ্দেশ্য ও কার্য-সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয় যে, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে …. পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যক্রমকে আরো শক্তিশীল ও গতিশীল করার লক্ষ্যে উক্ত পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্ন্তবর্তী পরিষদের সদস্য-সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন’ দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর এযাবৎ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এলক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নেরও কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেই ক্ষমতাসীন দল তাদের দলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে মনোনয়ন দিয়ে অন্তর্বর্তী জেলা পরিষদসমূহ অগণতান্ত্রিকভাবে বছরের পর বছর ধরে পরিচালিত করে আসছে। বস্তুত: ৫-সদস্য বিশিষ্ট অন্তবর্তীকালীন পরিষদসমূহের জনগণের কাছে কোন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। ফলে এসব পরিষদ এযাবৎ ক্ষমতাসীন দলের লোকদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ না নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য জেলা পরিষদে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এবং পরিষদের কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করার নামে সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর ৫৩(১) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, “সরকার পরিষদ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে কোন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করিলে পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের সহিত আলোচনাক্রমে এবং পরিষদের পরামর্শ বিবেচনাক্রমে আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগ্রহণ করিবে।” কিন্তু এই আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা করেনি। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মনে করে।
বস্তুত: তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনকে অব্যাহতভাবে পাশ কাটানো এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সুকৌশলে বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্যে সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মনে করে। শক্তিশালী পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন, পরিষদে সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি জনমুখী, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত পার্বত্য জেলা পরিষদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নির্বাচিত পার্বত্য জেলা পরিষদের কোন বিকল্প নেই। মনোনীত সদস্যদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদের আকার যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে করে কখনোই শক্তিশালী, গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক পার্বত্য জেলা পরিষদ গড়ে উঠতে পারে না বা সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতে পারে না। অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদের আকার বাড়ানো হলে সুবিধাবাদী ও কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কিছুই সাধিত হবে না। পক্ষান্তরে এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে এবং পার্বত্যবাসীদের প্রতি বঞ্চনা ও অবহেলা অধিকতর পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মনে করে।
প্রসঙ্গত ইহাও উল্লেখ্য যে, গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার নির্বাচনী ইসতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলেও সরকার এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সরকার পূর্ববর্তী মেয়াদের (২০০৯-২০১৩) শেষ পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৩ বিল ৯ম জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলেও অবশেষে তা সংসদীয় কমিটিতে ঝুলিয়ে রেখে দেয়। অপরদিকে গত ১-৩ জুলাই ২০১২ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার ও প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর অনুষ্ঠিত এক সভার মাধ্যমে অহস্তান্তরিত বিষয়সমূহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিলেও তাও অকার্যকর অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে। ঝুলিয়ে রাখা উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিয়ে সরকার উল্টো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থীভাবে ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন লঙ্ঘন করে অন্তর্বতীকালীন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আকার বাড়ানোর অগণতান্ত্রিক ও চুক্তি বিরোধী উদ্যোগ নিয়েছে। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কালক্ষেপণ ও অসদিচ্ছারই বহিপ্রকাশ বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মনে করে।
এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ (১৯৯৮ সংশোধিত) অনুসারে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না করে অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদের আকার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের এই সংশোধনী উদ্যোগে গ্রহণ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং এজন্য যে কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধনের উদ্যোগ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইন অনুসারে অনতিবিলম্বে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং এলক্ষ্যে অচিরেই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন বিধিমালা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জোর দাবি জানাচ্ছে।