জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে, যেখানে নাগরিকদের প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। মানবজাতির জন্য বিভিন্ন হুমকিস্বরূপ এটি একটি জটিল বহুমুখী, দীর্ঘমেয়াদী, বিস্ময়কর ধীর সূত্রপাত যেখানে উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ঝুঁকিতে বসবাস করছে যার জন্য অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম যেখানে এটা ধারণা করা হচ্ছে যে ২০৫০ সালের মাঝে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ বাংলাদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হবে। বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী ৩৫.০৮ মিলিয়ন মানুষ মূলত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মত অনেক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে আছে এবং আশা করা হচ্ছে যে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৫ সালে প্রায় ৪১.৮ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সালে ৫৭.৯ মিলিয়নে দাঁড়াবে।
অপর দিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে খরা বাড়বে যা উচ্চতর গড় তাপমাত্রা এবং শুষ্ক মৌসুমে কম বৃষ্টিপাতের সাথে সম্পর্কিত যেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯১ সালের মাঝে মোট ১৯টি খরা বাংলাদেশে ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন রকম দুর্যোগ যেমন, বন্যা, ঝড়, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও প্রবণতা বাড়ছে। নদী ভাঙ্গন একটি প্রধান সমস্যা, যার জন্য অধিকাংশ এলাকায় মানুষ তাদের বাসস্থান হারিয়েছে যেমন, খুলনার ফাশিয়াতলা গ্রামের মানুষ এখন রাস্তার পাশে বসবাস করছে এবং তাদের অধিকাংশই বাগেরহাট, ফেনী ও খুলনা সহ অন্যান্য শহরে চলে গেছে। ফাশিয়াতলার বাসিন্দা রেবেকা বেগমের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ একর জমি ছিল কিন্তু গত ১০ বছরে নদীভাঙ্গন মারাত্নকভাবে বৃদ্ধির কারণে সবকিছু নদীভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন কারণে, তাদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম পরিবর্তন হচ্ছে এবং লোকজন বিশ্বাস করে যে নদী ও কৃষি জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে নদীতে মাছ ও কৃষি ফসল উৎপাদন অত্যন্ত হ্রাস পাচ্ছে। উপরন্তু , গ্রীষ্মে অনেক বেশী তাপমাত্রা, বর্ষাকালে বাড়তি বৃষ্টি এবং শীতকালে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা এবং এই সব পরিবর্তনের কারণে মানুষ এবং একই সাথে ফসল উৎপাদনে ভোগান্তি বাড়ছে। গত দশ বছরে বৃষ্টি বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে বছরে ছয় মাস ক্রমাগত বৃষ্টি ঘটে এবং বছরে তিন মাস শুধুমাত্র অতিবৃষ্টি দেখা যায় । ঝড় এবং খরা অতিশয় বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে একটি বছরে পরপর ছয় মাসের খরা পরিলক্ষিত হয়।
জলবায়ু পরিবরতনের কারন এ উপকূলীয় অঞ্চল থেকে অনেক অভিবাসী দিন দিন ত্রাসজনক আকারে বাড়ছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঢাকা, খুলনা, মাদারিপুর এবং বরিশাল এর দিকে বেশি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত, মালয়েশিয়া, দুবাই, থাইল্যেন্ড ইত্যাদিতে বেশী। তারা তাদের বাসস্থান হারানোর পর বাংলাদেশের ভেতরে পরিবারকে সাথে নিয়ে অভিবাসনে যায়। মহিলাদের চাইতে পুরুষেরা অনেক বেশি অভিপ্রয়ান করে থাকে যা ভবিষ্যতে বাড়বে। বেশিরভাগ মহিলাই অভিবাসনে আগ্রহী নয় কারন তাদের আয় বৃদ্ধি মুলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন সুযোগ থাকে । মুলত, পরিবারের পুরুষ সদস্য অভিবাসনে যায় আর মহিলা এবং কিশোরী মেয়েরা খুব ঝামেলায় দিন কাটায় এবং দুর্যোগের সময় পুরুষ সদস্যরা কাছে না থাকায় শিশু, গর্ভবতী, বৃদ্ধরা অসহায় বোধ করে। তাছাড়া পরিবারের প্রধান হিসেবে পিতারা চান তাদের কন্যাদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে যাতে করে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং এভাবে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরন্ত, শহুরে অঞ্চলে মহিলা অভিবাসীদের সংখ্যাটাও বাড়ছে যেহেতু সেখানে তারা বাসাবাড়ির কাজে এবং গার্মেন্টস এ চাকরীর সুযোগ পাচ্ছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের উপর মারাত্মক হুমকিস্বরূপ যেটার প্রভাবে ১৮% ভূমি বন্যাআক্রান্ত হবে এবং সাথে সাথে ১১% জনগন সরাসরি এটার কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আরও হুমকির ব্যাপার হল ১ থেকে ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ৩৫% লোক শারীরিক অক্ষমতার স্বীকার হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঝুঁকি সূচক ২০১৬ (১৯৯৫-২০১৪) অনুযায়ী ১০টি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় জলবায়ু ঝুঁকি সুচকের ২২.৬৭ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছে।
প্যারিস চুক্তি আরও নজর দেয় বৈশ্বিক সাড়া জোরদার করার উপর একটা কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যাতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের চাইতে না বাড়ে এবং আরও চেষ্টা বাড়ানো হয় এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণটা ১-১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মাঝে রাখা যায় যেটা টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা রিপোর্ট ২০১৬ তে উল্লেখ করা আছে। তাছাড়া এই রিপোর্টে শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনে মোকাবিলা করার উপর নয় বরং আরও গুরুত্ত দেয়া হয় বাড়ন্ত জলবায়ু প্রভাবিত দুর্যোগ এবং বিপর্যয় রোধ করা এবং খাপ খাওয়ানোর উপর।
জলবায়ু স্থিতিস্থাপক প্রযুক্তির বাস্তবায়ন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রক প্রত্যাবর্তক যেটা পরিবেশগত ধকল কমাতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনের মাধ্যমে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে। যদিও এটা একটা আলাদা জোর দেয় নিয়ন্ত্রনের নিয়ামক হিসেবে সাম্প্রতিক ঘটনার উপর যেখানে অভিবাসন, পরিবেশগত পতন এবং জলবায়ু পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য।
লেখক : মোঃ আরিফ চৌধুরী, গবেষণা সহযোগী, DECCMA প্রজেক্ট, পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, Email: arifchowdhury065@gmail.com,